মহান মে দিবস, নারীশ্রম ও অদম্য শক্তি

ববি বড়ুয়া | রবিবার , ১ মে, ২০২২ at ৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ

নারীবিশেষ করে যারা এত বাধা আর প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেদের এগিয়ে নিতে চায়, তাদের পেছনটা টেনে ধরে কখনো অসহযোগিতা, কখনো অবমূল্যায়ন, এমনকি মাতৃত্বও।

বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট এসোসিয়েশন এর একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ক’বছর আগে। বেশ আড়ম্বরপূর্ণ এই অনুষ্ঠানের একটি পর্বে সদ্য পাশ করা ডাক্তারদেরও সংবর্ধনা দেয়া হয় যেখানে ষোল জনের চৌদ্দ জনই মেয়ে। দেখেই গর্বে বুক ভরে গেলো। খুশি ধরে রাখতে না পেরে বিশিষ্ট গবেষক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. সাহানারা ম্যাডামকে বললাম, আন্টি, ‘শিক্ষকতা পেশার মতো চিকিৎসা বিভাগও কি নারীদের দখলে চলে গেলো’? তখন তিনি উত্তরে বললেন ‘তাহলে তো গেলো সব শেষ হয়ে’। বললাম কেনো বলছেন এ কথা? উত্তরে ‘মেয়েদের আজ মাসিক, কাল পেটে বাচ্চা, পরশু বাচ্চার পড়াশোনা, তাদের ক্যারিয়ার। এসবের পেছনে ছুটতে ছুটতে চিকিৎসা শাখার বারোটা বাজবে’। গভীরভাবে চিন্তা করলাম কথাগুলো। ফলাফলে যা পেলাম তা হলো কথাটি অস্বীকার করার জো নেই।

যে মেয়েরা আজ অনেক স্বপ্ন বুকে লালন করে, এতো কষ্ট স্বীকার করে লেখাপড়া করে ডাক্তার হচ্ছে ভবিষ্যতে বড় কোনো সার্জেন হবে, গবেষণা করে নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করে চিকিৎসা বিভাগকে নতুন মাত্রা দান করবে, হয়তো মনোযোগ দিয়ে এগিয়ে গেলে সফলতাও পাবে। কিন্তু একটি সময় বিয়ে, নতুন পরিবেশে নিজেকে সাজাতে সময় লাগে, পরিবারে নতুন সদস্য আসে তাতে সময় যাবে দুতিন বছর, একটি সময় আসে সন্তানের লেখাপড়া, তাদের ভবিষ্যত নিয়ে উৎকণ্ঠা। কারণ সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করতে না পারলে ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। যার কারণে ডাক্তার মেয়েটির হাজার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও হয়তো নিজের স্বপ্নগুলোর টুটি চেপে ধরা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। হয়তো স্বামী, শ্বশুর বাড়ির সকলে সহায়তা করলেও অতি প্রাকৃতিক নিয়মেই একজন মা, সম্ভাবনাময়ী ডাক্তার আর বড় কোনো গবেষক বা উচ্চ পর্যায়ের কোনো সার্জেন হতে পারে না নেহায়েতই অনেক বেশী ক্যারিয়াস্টিক মন মানসিকতার নারী না হলে। বড়জোর গাইনোকোলজিস্ট হওয়া ছাড়া। আসলেই গভীরভাবে চিন্তা করলে বার বার এটাই মনে আসে প্রকৃতিই নারীকে এমনভাবে জড়িয়ে রাখে যেখান থেকে নারী শত চেষ্টা করেও সামনে এগিয়ে যেতে পারে না।

সেদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি দেখে মনটায় মোচড় দিল। ছবিতে দেখা যায় পাহাড়ের গায়ে একটি শুকনো গাছের ডালে সম্ভবত মায়ের চাদরে থলের মতো ঝুলানো। যাতে পাঁচছমাসের একটি শিশু সন্তান মায়ের অপেক্ষায়, যে মা তাকে এভাবে ঝুলিয়ে ঝুম চাষে ব্যস্ত। এভাবে সংসারের কাজ, সন্তান লালন পালন করে সে সংসারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনার চেষ্টা করে একই সাথে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ননে অসামান্য ভূমিকা রাখে।

এখানে শুধু দুটি শ্রেণি পেশার নারীর কথা বললেও নারীরা এখন কাজ করছেন সর্বত্র। চায়ের দোকানে চা বিক্রি, বাসায় বাসায় গিয়ে ময়লা নেয়া ( বিশেষ করে শহরাঞ্চলে), পোশাক কারখানায়, সড়কের নির্মাণ কাজে, কৃষি কাজে, ইট ভাঙার কাজ হতে শুরু করে ঘরে বসেই গৃহিণীরা করছেন ফ্রিল্যান্সার এর কাজ। বাংলাদেশে বর্তমানে সক্রিয় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করেন। এর মধ্যে ১১ শতাংশ, অর্থাৎ ৭১ হাজার ৫০০ নারী ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন। ইপ্ল্যাটফর্মের ডেটা বিশ্লেষণের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, অনলাইন কাজে ‘শ্রমিক বা ফ্রিল্যান্সার’ সরবরাহে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। বিশ্বের মোট বাজারের ১৬ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে রয়েছে। এটা বেশ আশা জাগায় মনে।

পুঁজিবাদ বিকারগ্রস্ত এই বিশ্বে আজ ‘মহান মে দিবস’। এই একটি মাত্র দিন, যে দিনে শ্রমিক নামক একটি শব্দের সহজ, সরল ব্যবহার হয়। আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজালে বন্দী এই দিনটিতে শ্রমিকদের প্রতি সহমর্মিতা, মমত্ববোধ হঠাৎ করেই উদিত হয়ে কে কার চেয়ে ভালো পোস্ট লিখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলে নিজেকে শ্রমিক বান্ধব বলে জাহির করা যায় সেই চেষ্টায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। নতুবা এই শ্রেণির কথাতো আমাদের মাথাতেই আসতে চায় না। অথচ বৈষম্যের অপর নাম পুঁজিবাদ শব্দটি (ধনীরা আরও ধনী, দরিদ্র আরও দারিদ্র্য সীমার নিচে) কিন্তু এই শ্রমিক শ্রেণির কাঁধে ভর করেই সৃষ্টি। মাঝে মাঝে মনে হয় এই দিনটি যদি বছরান্তে ঘুরে ঘুরে না আসতো তবে শ্রমিক শব্দটিই মুছে যেতো।

কিন্তু এই দিনের প্রতিপাদ্য কি তাও আমরা ক‘জন জানি বা জানতে চেষ্টা করি। তাই যদি না হবে তবে কেন এই বৈষম্য? আমরা একটু পেছনে গিয়ে যদি দেখি, একটি বিষয় বেশ মনে বাজে। ২০২০/২১ সালে কোভিড মহামারির সময়ে যখন সরকার সারাদেশে গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষণা করেছিলেন তখনও সুবিধা ভোগী প্রভু বা মালিক শ্রেণির সম্পদের পাহাড় গড়তে সব কারখানা খুলে দিয়ে কি বিচ্ছিরি খেলায় মেতেছিল। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। এক্ষেত্রে অর্থনীতির ভবিষ্যতের কথা যে একেবারে মাথায় না রেখে বলছি তাও না। কিন্তু বিষয় হলো জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের প্রাপ্য মজুরি কি সময়মতো বা পরিপূর্ণভাবে পরিশোধ করা হয়েছে তো ? বরং চলেছে অবাধে নির্দ্বিধায় নারী কর্মী ছাটাই।

অন্য সকল বিষয়ের পরিবর্তন হলেও আরেকটি বিষয় বরাবরই একই থাকছে তা হলো, চাকরি, কর্মসংস্থান ও কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়। এখনো আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই মূলত পুরুষদের শ্রমশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। নারীদের বিশেষ বাস্তবতাকে বিবেচনা করা হয় না। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীরা কম মজুরি ও প্রযুক্তি শ্রমের সঙ্গে যুক্ত আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী নারীদের সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয় না। যেখানে নারীরা চরমভাবে মজুরি বৈষম্যের শিকার।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের করা গবেষণা ‘রিয়ালাইজিং দ্য ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট ইন বাংলাদেশ প্রমোটিং ফিমেইল লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন’এ বের করেছে, জিডিপিতে নারীর ভূমিকা ২০ শতাংশ। এটি একজন নারী বছরে যত কাজ করেন, তার মাত্র ১৩ থেকে ২২ শতাংশের হিসাব। বাকি ৭৮ থেকে ৮৭ শতাংশ কাজের বিনিময়ে কোনো মূল্য পান না তারা। তাই ওই কাজের হিসাব জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না। তবে সংসারের ভেতর ও বাইরের কাজের মূল্য ধরা হলে নারীর অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, এক কোটি ৮৭ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছে। এটি যুক্ত হলে জিডিপিতে নারীর অবদান হতো পুরুষের সমান।

তবে যে নারীরা শুধু মজুরি বৈষম্যের শিকার তা বলা ভুল হবে। কারণ পুরুষের সমান পরিমান কাজ করেও পদোন্নতি বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রেও ঠকানো হচ্ছে পদে পদে। আর এর সাথে নারী বান্ধব পরিবেশের অভাবে যৌন নির্যাতনের শিকারও হতে হয় তা কখনো নীরবে আবার কখনো সরবে।

প্রকৃতির মায়াজালেই শৃঙ্খলিত নারী সমাজ যারা নিয়ত চেষ্টা করে চলেছে শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত হবার। অদম্য, অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে এগিয়ে চলেছে মিডিয়াকর্মী, সাংবাদিক, বৈমানিক, সৈনিক, চিকিৎসক, লেখকসহ নানা পেশায় মাথা উঁচু করে নিজেকে প্রমাণ করতে থাকা নারীরা। নিজের যোগ্যতায়, চেষ্টায় নারী এগিয়ে গেছে, এগিয়ে যাচ্ছে এবং তৈরি করছে উদাহরণঅন্য নারীর জন্য এবং সব পুরুষের জন্য। প্রমাণ করছে নারীর পেশার নির্ধারক সে নিজেই। কেননা, যে কাজে তার অংশগ্রহণ, তাতেই সে সফল হচ্ছেন।

মহান মে ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের রক্তঝরা দিন। সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দিবসটি পালন করা হয়। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ওই দিন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে জীবন দিতে হয়। এর পর থেকে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিনটি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের চরম আত্মত্যাগে ন্যায্য অধিকার আদায়ের এক অবিস্মরণীয় দিন।

উনিশ শতকের এই রক্তাক্ত ইতিহাসকে স্মরণ করে, শোষণের বিরুদ্ধে মেহনতী মানুষের জেগে ওঠার দিন পহেলা মে কে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে নিয়ে নারী পুরুষসহ সকল বৈষম্য বিলোপ করে ভবিষ্যতের ন্যায্য দাবী আদায়ের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে এবং এগিয়ে যাবে এই আশা রাখি। কারণ নারীকে বন্দী করে বা বাদ দিয়ে কখনো নিজের বা দেশের উন্নয়ন সাধন সম্ভব নয়। প্রকৃতির মায়াজালে শৃঙ্খলিত নারী। তবে তারা দুর্বল নয়, তাদের অপর নাম ‘অদম্য শক্তি’।

লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, ওমরগণি এমইএস কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঐতিহাসিক মে দিবস : শ্রমিকদের সকল সমস্যার সমাধানই হোক মূল লক্ষ্য
পরবর্তী নিবন্ধঈদুল ফিতর মুসলিম উম্মাহর গৌরবময় সংস্কৃতি