আমাদের উত্তর কাট্টলী গ্রামে পাকিস্তান আমলে ইসলামিক পন্থী দল সমূহ আর মুসলিম লীগের আধিক্য ছিল বেশি। বিশ্বাস পাড়া নিবাসী মরহুম এডভোকেট আব্দুর রশীদ চৌধুরী সর্বপ্রথম মুসলিমলীগের অত্যন্ত প্রতাপশালী নেতা আলহাজ্ব আলিম উল্যাহ চৌধুরীর সাথে বিরোধীদলীয় প্রার্থী হিসেবে (বিডি) ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তারই নেতৃত্বে কাট্টলী আওয়ামীলীগের উত্থান, কিন্তু নানা কারণে ভালোভাবে সংগঠিত হতে পারেনি কাট্টলী আওয়ামীলীগ।
তাই আমরা ছাত্রলীগ পুনর্গঠনে নেমে পড়লাম। আমি তখন জেলা ছাত্রলীগের এ.জি.এস। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি হতে সদস্য সংগ্রহ করা শুরু করলাম। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা অসংখ্য কর্মীর পদচারণায় মুখরিত কর্ণেল হাটে ছাত্রলীগ অফিস উদ্বোধন করলাম। প্রথমে এম.এ জাফর ভাইকে সভাপতি এবং বাবুল কান্তি সেনকে সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে নুরুদ্দীন ভাইকে সভাপতি ও মরহুম আব্দুল মতিনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ঊনসত্তরের ৬ দফা আন্দোলন পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলনে কাট্টলীতে যাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল তারা হলেন এড. আলী আজগর চৌধুরী, এড. নাজিমউদ্দিন, নুরুউদ্দীন, শফিউল আলম (ব্যাংকার), শফিকুল আলম (মামা), এম.এ জাফর, পীর মোহাম্মদ, বাবুল কান্তি সেন, মোহা. ফারুক, মোহাম্মদ লোকমান, ডা. ছালাউদ্দিন, নাছিমুল গণি, সুলতান আহমেদ, হারুনুর রশীদ, নুরুল আবছার, নুরুদ্দীন আহমেদ চৌধূরী, চৌধুরী শওকত আলী, সামশুল আরেফিন, আলমগীর, নজরুল ইসলাম, সমীর দত্ত, গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী সহ আরো অনেকে। যাদের নাম এ মুহূর্তে আমি স্মরণ করতে পারছি না, সেজন্য দুঃখিত।
তাছাড়া ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাপ (মোজাফ্ফর) সমর্থিত কর্মীদের মধ্যে এড. আনোয়ারুল কবির চৌধুরী, শাফিকুল আলম (দুদু মিঞা), আবুল কালাম আজাদের নাম উল্লেখযোগ্য। ৬৯’–৭০’ সালে কাট্টলী কর্ণেলহাট মাঠে অনেকগুলো রাজনৈতিক জনসভা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে আব্দুল মালেক উকিল, আ.স.ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন সহ অনেকেই বক্তৃতা করেছেন। স্থানীয় নেতাদের মধ্যে মরহুম এম.এ আজিজ, মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম.এ হান্নান, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, এম.এ মান্নান এর নাম উল্লেখযোগ্য। শিল্প এলাকায় অবস্থান হওয়ায় এ মাঠে প্রচুর লোক সমাগম হতো। বিশেষ করে ভিক্টোরিয়া জুট মিলের (ইস্পাহানী) খালেক সরদারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। পাহাড়তলী এলাকার প্রতিটি মিল কারখানা তখন আমাদের নির্দেশনা মানতো। প্রতিটি শ্রমিক জনসভায় ছাত্রনেতা হিসেবে আমার বক্তৃতা করার সৌভাগ্য হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ৭১’ এর ফেব্রুয়ারি/মার্চ মাসে কাট্টলীতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে তরুণেরা সংগঠিত হচ্ছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়তে। আলহাজ্ব জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাড়ির মাঠে প্রতি রাতে আমরা ট্রেনিং করেছি প্রাক্তন সামরিক বাহিনীর সদস্যের নেতৃত্বে। যার সুবাদে প্রাথমিকভাবে ফিরোজশাহ কলোনীর বিহারীদের আক্রমণ প্রতিহত করতে আমরা সক্ষম হয়েছিলাম।
৭১’ এর ২৬শে মার্চ রাতে একখানা সাইক্লোস্টাইলে ছাপা লেখা চিঠি আমাদের হাতে এলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা। আমরা সেটি কাট্টলীর বাড়ি বাড়ি প্রচার করতে শুরু করলাম। পাকিস্তানপন্থ্থী অনেকের কাছ থেকে বাধারও সম্মুখীন হয়েছিলাম। ঐদিন খুব ভোরে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা অসংখ্য সেনাবাহিনীর সদস্যদের আমাদের এলাকায় আসার খবর পেলাম। সবার হাতে অস্ত্র সবাই সামরিক পোশাকে সজ্জিত। সবাই নিরাপদ আশ্রয়স্থল খুঁজছে। অনেকেই ইউনিফর্ম পাল্টিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে নিজ নিজ এলাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। বাকীরা থেকে গেলেন আমাদের গ্রামে, বিভিন্ন বাড়িতে ভাগাভাগি করে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। শুরুতেই পাকিস্তানি সেনাদের মর্টার সেলের আঘাতে প্রাণ হারালেন কাট্টলী বিশ্বাস পাড়ার মৌলানা সৈয়দ ও মোহা. ইদ্রিস। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা, ছাত্রলীগের সমীর দত্ত (বুলবুল) এর বাবা ডা. অনন্ত মোহন দত্তের মৃত্যু, কর্নেল হাট থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাক সেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে কৈবল্যধাম এলাকায়।
বাঙালি সেনাদের কাছ থেকে পাওয়া একটি থ্রি নট থ্রি (৩০৩) রাইফেল দিয়ে সারারাত সিডিএ (পাহাড়তলী) পুলিশ ফাঁড়ি পাহারা দিয়েছি আমি আর বিশ্বাস পাড়ার হেলাল উদ্দিন। কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র হিসেবে আমাদের জে.সি.সি ট্রেনিং ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। গ্রামে পাকিস্তানি শান্তি কমিটির সদস্যদের ভয়ে রাতে বাড়িতে থাকা হতো না। আমি আর আজগর ভাই আমাদের পাশের বাড়ির রফিকদের কুঁড়েঘরে রাত কাটাতাম। রফিকের বৃদ্ধা দাদী আমাদের খুবই আদর যত্ন করতেন। সে স্মৃতি কোনও দিন ভুলতে পারব না। কিছুদিন আমাদের মীরসরাই মাহালাঙ্গা গ্রামে আমাদের এক ফুফুর বাড়িতেও লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। এভাবে কয়েক মাস কাটিয়ে ছাত্রনেতা পটিয়ার এস.এম ইউসুফ ভাইয়ের দু’ লাইনের একটি চিরকুট পেয়ে ভারতের হরিনা ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
কাট্টলী দারোগা বাড়ির মরহুম নুরুল আবছারের তত্ত্বাবধানে কাট্টলীর একদল ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়ে কর্ণেলহাট থেকে বাসে মীরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ, পরে আবুরহাট হয়ে সমুদ্রর বাঁধ ধরে হেঁটে হেঁেট সোজা ছাগলনাইয়া থানা। আবুরহাট বাজারে কুপি বাতির আলোতে সন্ধ্যার সময় লম্বা টুলে বসে একটি হোটেলে গরুর গোশত দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম তা এখনো মনে পড়ে। শেষ রাতে আমরা ভারতের বর্ডারে গিয়ে পৌঁছালাম। কিন্তু এর আগে একটা অঘটন ঘটে গেল। ছাগলনাইয়া থানায় একদল দুষ্কৃতকারী আমাদের ঘিরে ফেললো এবং নির্দেশ দিল মুক্তিবাহিনী আর শরণার্থী আলাদাভাবে দাঁড়াতে। তখন চিন্তায় পড়ে গেলাম কোন দলে যাব। যাক শেষ পর্যন্ত আল্লাহর উপর ভরসা করে মুক্তিবাহিনীর লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। পরে শুনেছি শরণার্থীদের কাছ থেকে টাকা পয়সা লুট করা হয়েছে।
ঐদিন আমরা বর্ডার পার হওয়ার কয়েকঘণ্টা আগে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডে পাক সৈন্যদের গোলাগুলিতে অনেকে হতাহতের খবর চারিদিকে প্রচারিত হওয়ায় আমাদের বাড়িতেও কান্নাকাটির রোল পড়েছিল। ভোর বেলায় ভারতীয় এলাকা থেকে ট্রাক যোগে আমাদের ত্রিপুরা হরিনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন বড় ভাই এডভোকেট আবু মোহাম্মদ হাশেম, চট্টগ্রাম কলেজের জালাল ভাই, নঈম উদ্দিন, ছাবের আহমেদ আজগরী, এস.এম. ইউসুফ, মহিউদ্দিন। এরা সবাই তখন ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। আমরা যখন গেলাম তখন বর্ষাকাল। ক্যাম্পের অবস্থা খুবই খারাপ। দুবেলা রুটি আর ডাল খেতে খেতে প্রায় সবারই ব্ল্যাড ডিসেন্ট্রি।
বাঁশ দিয়ে তৈরী চাটাইতে কোনও মতে শোবার ব্যবস্থা। দুদিন পরেই আমাদের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেল। হরিনা তখনও ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে পরিচালিত হচ্ছিল। সেখানে বাংলাদেশের মেজর রফিকুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন এনাম এবং ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এম. পি. কে দেখেছি। রাইফেল, গ্রেনেড আর এক্সপ্লোসিভ চালানো শিখানো হলো।
এবার দেশে ফেরার আগে ইচ্ছে হলো আগরতলায় গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে থাকা আলহাজ্ব জহুর আহমেদ চৌধুরী ও আমার চাচা ন্যাপ নেতা এডভোকেট আনোয়ারুল কবির চৌধুুরীর সাথে দেখা করতে। আমার বাল্যবন্ধু কাট্টলীর হারুনুর রশীদকে নিয়ে আউট পাশ সংগ্রহ করে আগরতলায় গেলাম। আগরতলায় পৌঁছে জহুর আহমেদ চৌধুরীর সাথে দেখা করলাম। তিনি আমাদের কাছ থেকে এলাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানলেন এবং বাংলাদেশ স্টুডেন্ট ফান্ড থেকে আমাদের দুজনকে ৪০ টাকা করে দিলেন।
সেদিনের ৪০ টাকা পেয়ে যে খুশী হয়েছিলাম আজকে মনে হয় ৪০ লাখ টাকা পেলেও অত খুশী আসবে না। পরে চাচা আনোয়ারুল কবির চৌধুরীকে দেখতে গেলাম, যেখানে বাংলাদেশের ন্যাপ (মোজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা থাকতেন সেই বিল্ডিংয়ে (ক্রাফট্ হোস্টেল)। অগ্নিকন্যা বেগম মতিয়া চৌধুরীকেও দেখলাম রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকতে। রাত সেখানেই কাটালাম। পরদিন সেখান থেকে বিদায় নিয়ে হরিনা ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হবার পূর্বে পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেল আওয়ামীলীগ নেতা এম.এ. মান্নান ও আ.স.ম আব্দুর রবের সাথে। মান্নান ভাই সাথে সাথে আমাকে সি.এন. সি স্পেশাল ট্রেনিং এর জন্য মনোনীত করে ফেললেন। কিন্তু বন্ধু হারুনের কান্নাকাটির কারণে আমার আর সেদিকে যাওয়া হলো না।
হরিনা ক্যাম্পে এসে কাট্টলীর সেলিম, জসিম, মোহা. হোসেন, ইমাম হোসেন, নেজামত উল্লাহ, হারুনুর রশীদ সহ অন্যান্যদের নিয়ে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে আমরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়লাম। সেদিন থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় চলেছে আমাদের অপারেশন। বিজয়ের পর কাট্টলী কমিউনিটি সেন্টারে মুক্তিবাহিনীর দপ্তর খোলা হলো। সে সময় কমান্ডার শাহাবুদ্দিন আহমেদ, মোহা. হোসেন, সেলিম উল্ল্যাহ এদের তৎপরতা ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়। প্রায় সকলের হাতে বৈধ, অবৈধ অস্ত্র, যে কারণে চেইন অব কমান্ড বলতে কিছুই ছিল না। পরবর্তীতে ফিরোজশাহ্ বিহারী কলোনী এবং পাকিস্তানি মালিকানাধীন বিভিন্ন মিল ফ্যাক্টরীগুলোতে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। সবই ইতিহাস, সবই স্মৃতি।
লেখক: এডভোকেট, সাবেক সহ–সভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি।