বুদ্ধিমান মোমিন কল্যাণের প্রতি ধাবিত হয়। যেসব কাজে আল্লাহতায়ালা সন্তুষ্ট হন যেসব কাজ তাঁর নিকটবর্তী করে সেসব কাজে আগ্রহী হয়। যেসব কাজ তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে দেয় তা এড়িয়ে চলে। বিরত থাকে সেসব কাজ থেকেও যা তার দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতির কারণ হয়। যে জিনিসের নৈকট্য উপকারী তার কাছাকাছি থাকতে হবে। আর যে জিনিসের নৈকট্য ক্ষতিকর তা থেকে দূরত্বে অবস্থান করতে হবে। এটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। আল্লাহতায়ালার নৈকট্যই সবচেয়ে উপকারী। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা, কাজ ও মৌন সমর্থিত বিষয়াবলিই একজন মুমিনের জীবন পথের পাথেয়। কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন রাসুল তোমাদের কাছে যা নিয়ে এসেছেন তা আঁকড়ে ধরো এবং যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেছেন তোমরা বিরত থাকো (তা থেকে)। হাদিসের আলোকে জীবন গঠন করা প্রতিটি মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। একজন মুসলিমের জীবনে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেয়ে বড় কোন আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে কি? সামাজিক স্ট্যাটাস ও দুনিয়াবি নানান স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে আমরা প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের প্রিয়ভাজন হতে কিংবা তাদের পরিচিতজনের তালিকায় নিজেকে যোগ করতে চেষ্টার কোনো কমতি রাখি না। অথচ পরম করুণাময় অসীম দয়ালু সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের ব্যাপারে আমরা কেমন যেন উদাসীন। পবিত্র সময়ে আল্লাহর রহমত ও নৈকট্য লাভের জন্য দোয়া ও মোনাজাত বিশেষ মুহূর্তে ও হৃদয়ের আকুতি নিয়ে প্রার্থনা করুন গুনাহ মাফের জন্য হাত তুলুন এবং আত্মশুদ্ধির পথে এগিয়ে যান।
মোনাজাতের গুরুত্ব : মহান আল্লাহ বলেছেন তোমরা আমাকে ডাকো আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন আমার বান্দা যখন আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে (জেনে রাখো) আমি কাছেই। আয়াতদ্বয়ে আল্লাহকে ডাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহর কাছে মোনাজাতের গুরুত্ব কতটুকু? এই বিষয়ে হাদিসগুলো থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে মানুষ কাজ করে বিনিময় ছাড়া ফিরে যাওয়া যেমন বিফল তেমনি আল্লাহর ইবাদত–বন্দেগি করে আল্লাহর কাছে চেয়ে কিছু আদায় না করাটাও বিফল বোকামি। আল্লাহও চান তার বান্দারা তার কাছে দোয়া করুক। কিছু চেয়ে নিক। আল্লাহ তাদের মোনাজাত ও দোয়ার বদৌলতে কিছু দিতে চান। দোয়াকে হাদিসের ভাষায় ইবাদতের মগজ বলা হয়েছে। মগজ ছাড়া যেরূপ একজন মানুষ বাঁচতে পারে না সেরূপ দোয়া না করলেও ইবাদত সার্থক হয় না। তাই আল্লাহর কাছে মোনাজাত না করার মতো বোকামি আর কিছুই নেই। আমাদের অনেকে নামাজের পর দোয়া করে আল্লাহর কাছ থেকে কিছু আদায় করার প্রয়োজন নেই মনে করে দোয়া না করেই উঠে যায়। হাদিসে বর্ণিত আছে আল্লাহর কাছে দোয়া অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় ও সম্মানিত অন্য কোনো বিষয় নেই। দোয়ার শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত আছে তাকদির কেবল দোয়ার মাধ্যমেই পরিবর্তন হয়।
দোয়ার গ্রহণীয়তা : বান্দা দোয়া করলে মেঘমালা ও সাত আসমান অতিক্রম করে আরশে পৌঁছে। দোয়া কবুলের জন্য শর্ত হলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে দোয়া করা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন তোমরা এই বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে যে আল্লাহ তোমাদের দোয়া কবুল করবেন এবং জেনে রাখবে আল্লাহ অমনোযোগী ও উদাসীন অন্তরের দোয়া কবুল করেন না। দোয়া করার সময় আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে যে আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেন। বান্দা আল্লাহকে যেরূপ মনে করবে আল্লাহ তার জন্য সেরূপই হবে। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে আল্লাহতায়ালা বলেন আমার বান্দা আমার ব্যাপারে যেরূপ ধারণা করে আমি সেরূপ। সে জন্যই সম্পূর্ণ পরিষ্কার অন্তর নিয়ে কাকুতি মিনতি সহকারে আত্মবিশ্বাস নিয়ে দোয়া করতে হবে।
নামাজের পর হাত তুলে দোয়া করা : রাসুল (সা.) থেকে ২২টি জায়গায় দোয়া করার হাদিস রয়েছে। তার মধ্যে ফরজ নামাজের পর অন্যতম। ফরজ নামাজের পর হাত তুলে মোনাজাত করা মুস্তাহাব আমল। এ বিষয়ে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো।
এক. মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বায় আসওয়াদ আমেরি তার বাবার সূত্রে বর্ণনা করেন তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.) এর সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করেছি তিনি সালাম ফেরানোর পর পাশ ফেরালেন এবং হাত তুলে দোয়া করলেন।
দুই. রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন তোমরা যখন মোনাজাত করবে তখন হাতের পেট সামনের দিকে রেখে মোনাজাত করবে। আর হাতের পিঠ সামনের দিকে রেখে আল্লাহর কাছে কিছু চাইবে না। এরপর প্রার্থনা করা শেষ হলে মুখের ওপর হাত মুছে ফেলবে।
তিন. ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (সা.) দোয়া করার সময় হাত উঠাতেন তার চেহারা মাসেহ না করে হস্তদ্বয় নামাতেন না।
চার. সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন নিশ্চয়ই তোমাদের পালনকর্তা লজ্জাশীল ও দয়ালু। যখন তার কোনো বান্দা তার কাছে হাত তুলে দোয়া করে তখন তিনি উক্ত হাতকে খালি ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।
পাঁচ. আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (সা.) দোয়া করার সময় অধিক অর্থবহ শব্দ ব্যবহার করতেন।
ছয়. আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন অনুপস্থিত ব্যক্তি অন্য অনুপস্থিত ব্যক্তির জন্য যে দোয়া করে তা সবচেয়ে দ্রুত কবুল হয়। অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে কারও অনুপস্থিতিতে দোয়া করলে দোয়াকারীর জন্য ফেরেশতা নিজেই দোয়া করেন এবং বলেন হে আল্লাহ! এই ব্যক্তি তার অপর ভাইয়ের জন্য যা কামনা করছে তা তাকে দিয়ে দিন।
সাত. ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (সা.) ওমরা হতে যাওয়ার সময় আমাকে বললেন হে ভাই! তুমি যখন দোয়া করবে তখন আমাদের জন্যও দোয়া করবে। আমাদের ভুলে যেয়ো না।
সুতরাং মহান আল্লাহর কাছে আমাদের দোয়া করতে হবে। সবার জন্য মঙ্গলের দোয়া করতে হবে। নামাজের পর দোয়া কবুলের মোক্ষম সময় বিধায় গুরুত্ব সহকারে হাত তুলে কাকুতি মিনতি করে দোয়া করা উচিত। দুনিয়াবি জিনিসের তুলনায় আখেরাতের বিষয়ে দোয়া করতে হবে। বিশেষ করে গুনাহসমূহের ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। রাসুল (সা.) প্রায় সময় যেসব দোয়া করতেন সেসবের মধ্য থেকে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।
এক. রব্বানা আতিনা ফিদ্দুনইয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আ–খিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান্নার। অর্থাৎ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ইহকাল ও পরকালে মঙ্গল দান করুন এবং জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন। (সুরা বাকারা : ২০১)
দুই. আল্লাহুম্মা ইন্নি আস আলুকাল আফওয়া ওয়াল আফিআতা ফিদ্দুনইয়া ওয়াল আখিরাহ। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাই এবং দুনিয়া ও আখেরাতে প্রশান্তি চাই।
তিন. আল্লাহুম্মা লা মানিআ লিমা আ’তাইতা, ওয়ালা মু’তিয়া লিমা মানা’তা, ওয়ালা ইয়ানফাউ যালজাদ্দি মিনকাল জাদ্দু। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি যা প্রদান করেছেন তা বন্ধ করার কেউ নেই আর আপনি যা রুদ্ধ করেছেন তা প্রদান করার কেউ নেই। কোনো ক্ষমতার অধিকারীর ক্ষমতা আপনার কাছে কোনো উপকারে আসবে না। এছাড়াও হাদিসের সব কিতাবে রাসুল (সা.) থেকে বহু দোয়ার কথা প্রমাণিত রয়েছে।
সারগর্ভ দোয়া : আবু উমামা (রা.) বলেন রাসুল (সা.) আমাদের অনেক দোয়ার বিষয়ে বলেছিলেন যা আমরা স্মরণ রাখতে পারিনি। রাসুলুল্লাহ বললেন আমি তোমাদের একটি দোয়া বলে দিচ্ছি এতে সব দোয়াই এসে যাবে। তোমরা আল্লাহর দরবারে এভাবে দোয়া করবে : আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন খাইরি মা সাআলাকা মিনহু নাবিয়্যুকা মুহাম্মাদুন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া আউযু বিকা মিন শাররি মাসতাআযাকা মিনহু নাবিয়্যুকা মুহাম্মাদুন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়া আনতাল মুসতাআনু ওয়া আলাইকাল বালাগ ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুওওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে সেই কল্যাণ চাই যা আপনার নবী মুহাম্মদ (সা.) আপনার কাছে চেয়েছেন এবং আমরা আপনার কাছে এমন অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই যে অনিষ্ট থেকে আপনার নবী মুহাম্মদ (সা.) আশ্রয় চেয়েছেন। আপনিই একমাত্র সাহায্যকারী এবং আপনিই (কল্যাণ) পৌঁছিয়ে দিন। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও অনিষ্ট রোধ করার এবং কল্যাণ পৌঁছানোর ক্ষমতা নেই। আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাঁর নৈকট্য অর্জনে ভালোবাসা লাভ এবং কুরআন–সুন্নাহ মোতাবেক পছন্দনীয় নেক আমলগুলো করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট