রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর উপশহর ক্রাসনোগর্স্কের এক সিটি হলে কনসার্টের আগে বন্দুকধারীদের গুলিতে ১৪৩ জন নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন চার বন্দুকধারীসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী।
ক্রেমলিন জানিয়েছে, রাশিয়ার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির প্রধান আলেকসান্দার বর্তনিকোভ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে জানিয়েছেন, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে ‘চার সন্ত্রাসী’ আছে আর এফএসবি তাদের সহযোগীদের শনাক্ত করতে কাজ করে যাচ্ছে। রাশিয়ার তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, হামলায় ১৪৩ জন নিহত হয়েছে। শুক্রবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় সামরিক বাহিনীর মতো পোশাক পরা অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে সঙ্গীতানুষ্ঠানে আগত লোকজনের দিকে নির্বিচার গুলি ছোড়ে। হামলায় পাঁচজন বন্দুকধারী অংশ নিয়েছে বলে বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্স জানিয়েছে। রাশিয়ার তদন্তকারী আইন কর্মকর্তারা ঘটনাটিকে সন্ত্রাসী হামলা বলে অভিহিত করেছে। এ ঘটনায় একটি ফৌজদারি দায়ের করে তারা তদন্ত শুরু করেছে। হামলার পেছনে দায়ীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি তার শত্রুদের আন্তর্জাতিক শত্রু বলে বর্ণনা করে বলেছেন, তাদের দমনে যেকোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে কাজ করতে তিনি প্রস্তুত আছেন। রাশিয়ার কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে গ্রেপ্তার ৪ সন্দেহভাজন হামলাকারী তাজিকিস্তানের নাগরিক বলে খবর প্রকাশ করা হয়। তবে তাজিকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সে দেশের নাগরিকের রাশিয়ায় হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। রাশিয়ার সন্দেহ, এ হামলার পেছনে ইউক্রেনের হাত আছে। এছাড়া ২৪ মার্চকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
রাশিয়ার আইনপ্রণেতা আলেকসান্দার কাইনেস্তিন জানিয়েছেন, হামলাকারীরা একটি রেনো গাড়িতে করে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়, পরে শুক্রবার রাতে মস্কো থেকে ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ–পশ্চিমে ব্রাইয়ানস্ক অঞ্চলে গাড়িটিকে দেখতে পায় পুলিশ। তাদের থামার সংকেত দিলে তা না মেনে এগিয়ে যায় তারা।
গাড়ি নিয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করে দুজনকে আটক করে পুলিশ। আরও দুজন পাশের বনে পালিয়ে যায়। ক্রেমলিনের ভাষ্য অনুযায়ী, পরে তাদেরও আটক করা হয়।
কাইনেস্তিন জানান, গাড়িটিতে তাজিকিস্তানের কয়েকটি পাসপোর্ট, পিস্তল ও স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের একটি ম্যাগাজিন পাওয়া গেছে। মধ্য এশিয়ার মুসলিম প্রধান দেশ তাজিকিস্তান আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল।
ইসলামিক স্টেটের আফগানিস্তান শাখা ইসলামিক স্টেট খোরসান (আইএসআএস–কে) হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে তাদের বার্তা সংস্থা আমাকের টেলিগ্রাম পেইজে জানানো হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দারা এমনটি নিশ্চিত করেছেন বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা। রয়টার্স জানিয়েছে, ২০০৪ সালে বেসলান স্কুলে হামলার ঘটনার পর এটিই রাশিয়ায় হওয়া সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলার ঘটনা।
সোভিয়েত আমলের রক সঙ্গীতের দল ‘পিকনিক’ মস্কোর শহরতলীর ৬২০০ আসনের ক্রোকাস সিটি হলে অনুষ্ঠান শুরু করার ঠিক আগে বন্দুকধারীরা সেখানে আগত দর্শকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। হলটি তখন কানায় কানায় ভরা ছিল। যাচাই করা ভিডিওতে দেখা গেছে, সঙ্গীতানুষ্ঠান উপভোগ করতে আগত দর্শকরা তাদের আসন গ্রহণ করছেন, তখনই একের পর এক গুলির শব্দের মধ্যে তারা চিৎকার করে বের হওয়ার দরজার দিকে ছুটতে শুরু করেন। অন্য ভিডিওতে দেখা গেছে, কয়েক ব্যক্তি লোকজনের দলের ওপর গুলিবর্ষণ করছে। গুলিবিদ্ধ কিছু মানুষ জমে থাকা রক্তের মধ্যে নিথরভাবে পড়ে আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, হঠাৎ আমাদের পেছনে বিকট শব্দ হতে লাগল, গুলির শব্দ। একটানা গুলির শব্দ। হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। সবাই এসকেলেটরের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল। সবাই চিৎকার করছিল আর দৌড়াচ্ছিল। শুক্রবারের এ ঘটনায় আরও অন্তত ১৪৫ জন আহত হয়েছে বলে রাশিয়ার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এক বিবৃতিতে আইএস বলেছে, তাদের যোদ্ধারা মস্কোর শহরতলীতে হামলা চালিয়েছে। কয়েকশজনকে হত্যা ও আহত করেছে এবং স্থানটির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। তারপর তারা নিরাপদে তাদের ঘাঁটিতে ফিরেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, আইএসের ওই গোষ্ঠীটির দাবি বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু রাশিয়া এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
হামলার বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছিল যুক্তরাষ্ট্র : রাশিয়াকে যেমনটা সতর্ক করেছিল, মস্কোর এক কনসার্ট অনুষ্ঠানে গুলিতে ১৪৩ জনের প্রাণহানির মধ্যে দিয়ে সেটিই সত্যি হলো। বিবিসি বলছে, মস্কোতে কোনো বড় জনসমাগমস্থলে হামলা হতে পারে, তা এ মাসের শুরুর দিকেই রাশিয়ার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র আদ্রিয়েন ওয়াটসন বলেন, মস্কোতে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা হচ্ছে, বিশেষ করে কনসার্টসহ কোনো জনসমাগমস্থলে–এমন তথ্য এ মাসের শুরুর দিকেই যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এসেছিল। ওয়াশিংটন সেই তথ্য রাশিয়ার কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সেই সতর্কবার্তাকে মিথ্যা প্রচার বলে উড়িয়ে দেয় ক্রেমলিন। ওই সময় রাশিয়ায় থাকায় নাগরিকদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রকাশের পরও তাতে কান দেয়নি রাশিয়া।
জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন মার্কিন গোয়েন্দারা। আইএস যেভাবে সাধারণত হামলা করে, তার সঙ্গে এই হামলার মিল রয়েছে। অর্থাৎ কোনো স্থানে হামলা চালিয়ে যত বেশি সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা যায়, ঠিক তেমনটাই দেখা গেছে মস্কোর এই ঘটনায়।
২০১৫ সালে প্যারিসের এক কনসার্টেও একই ধরনের হামলায় এই জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগ ছিল। তবে আসলেই শুক্রবারের হামলাটির জন্য কারা দায়ী, বর্তমান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিতে পারে। ইউক্রেন যেহেতু রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে রয়েছে, এমন অবস্থায় মস্কো এই হামলার দায় তাদের ওপর চাপাতে পারে, এমনটা ভেবে উদ্বিগ্ন হতে পারে দেশটি ও তার মিত্ররা।
কনসার্টসহ কোনো জনসমাগমে সন্ত্রাসী হামলার বিষয়ে গত ৭ মার্চ রাশিয়ায় নাগরিকদের জন্য যে সতর্কবার্তা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেই সতর্কবার্তা দেওয়া হলেও রাশিয়ার কর্মকর্তারা তা নাকচ করে দিয়েছিলেন। এখন এই হামলার পর মস্কোর কী প্রতিক্রিয়া জানায় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা : মস্কোর উপশহর ক্রাসনোগর্স্কের ক্রোকাস সিটি হল একটি বিশিষ্ট কনসার্ট ভেন্যু। এখানে প্রায় ২০ বছরের মধ্যে রাশিয়ায় হওয়া সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলায় অন্তত ১৪৩ জন নিহত হয়েছেন।
নির্বিচার গুলিবর্ষণের এই ঘটনাস্থল থেকে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তদন্তকারীরা রাতভর কাজ করেছেন। তারা বন্দুকধারীদের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত অস্ত্র ও গোলাগুলি খুঁজে পেয়েছেন। বিবিসি জানিয়েছে, শেষ খবর পর্যন্ত রাশিয়ার কর্মকর্তারা হামলাকারীরা কারা বা তারা কোথায় আছে, সে সম্পর্কে তেমন কিছু বলেননি। শুক্রবার রাতেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, হামলাকারীরা পালিয়ে গেছে এবং পুলিশ তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) একটি শাখা বলেছে, তারা হামলাটি চালিয়েছে। কিন্তু মস্কো তাদের এ দাবির বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। মস্কো ও রাশিয়ার অন্য শহরগুলোতে শনিবার ভোরে ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডগুলোতে জ্বলন্ত একটি মোমবাতি ও নিচে ‘আমরা শোক জানাই’ লেখা দেখা গেছে।
ক্রোকাস সিটি হলের বাইরে একজন প্রত্যক্ষদর্শী রয়টার্সের সাংবাদিককে বলেছেন, বন্দুকধারীরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করেছে। রাশিয়ার গণমাধ্যমগুলোতে আসা ভিডিওগুলোতে ক্রোকাস সিটি হলে আগুন জ্বলতে এবং সেখানে থেকে আগুনের শিখা ও ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। ভেতরে অনেকে রয়ে গিয়েছিল আর পুরো ভবনটিকে আগুন গ্রাস করে নিয়েছিল, অনেকে ছাদেও আটকা পড়েছিল। শনি ও রোববার মস্কোজুড়ে সব বড় ধরনের জমায়েত বাতিল করেছেন নগরীর মেয়র।