মশক নিধনে সাফল্য কোথায়

প্রশ্ন নগরবাসীর ।। ১৩ বছরে ব্যয় ১৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ।। নগরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না

মোরশেদ তালুকদার | রবিবার , ২০ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

মশার জ্বালা,/ জীবন হলো ঝালাপালা,/ সুস্থভাবে বেঁচে থাকা/ হলো ভীষণ দায়,/ রক্তখেকো মশার জ্বালায়/ জীবন যে তড়পায়।’

কবীর হুমায়ূনের ‘মশা’ কবিতায় যেন এ সময়ের বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। মাত্র ২ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম ওজন মশার। এরপরও তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি ওজনের মানুষকে ধরাশায়ী করে ফেলে ছোট্ট এ পতঙ্গটি। মশার কামড়ে হতে পারে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া বা ফাইলেরিয়াসহ নানা রোগব্যাধি। তাই তো সারাক্ষণ মশার ভয়ে তটস্থ থাকে লোকজন। এমন উৎকণ্ঠা থেকেই অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘ক্ষুদ্র মশা!/ মশার কামড় খেয়ে আমার-/ স্বর্গে যাবার দশা!…’

১৮৯৭ সালে আবিষ্কৃত হয়, ম্যালেরিয়া রোগের সঙ্গে মশার সম্পর্ক আছে। তখন থেকেই সচেতনতা বাড়ে মশা নিয়ে। অবশ্য তারও আগে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘রাতে মশা দিনে মাছি, দুই তাড়িয়ে কলকাতায় আছি’। অর্থাৎ মশার কামড়ে রোগ হতে পারেএমন ধারণার আগে মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন লোকজন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ছড়ায় তৎকালীন সময়ে মশামাছির যন্ত্রণায় কাতর কলকাতাবাসীর দুঃখ কিছুটা হলেও ফুটে উঠেছে।

এর ১৯২ বছর পর এসে চট্টগ্রাম শহরের বাসিন্দাদের কষ্ট যেন কলকাতার চেয়েও বেড়েছে। কারণ, এখানে শুধু রাতে না, বরং দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা সমানতালে কামড়াচ্ছে মশা। সকালসন্ধ্যা বাসাবাড়ি, দোকানপাট, অফিসআদালত সবখানেই ‘গুনগুন’ ধ্বনিতে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে মশা।

মশা থেকে নগরবাসীকে রক্ষার দায়িত্ব কার? মাঝেমধ্যে অতিষ্ঠ নগরবাসী এ প্রশ্ন করেন। এক্ষেত্রে বলা যায় ‘স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯এর তৃতীয় তফসিলের ১ নং অনুচ্ছেদে ‘জনস্বাস্থ্য’ বিষয়ে যে ক্ষমতা তার আলোকেই মশক নিধনে ব্যবস্থা নিতে হবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে (চসিক)। অবশ্য চসিকও দাবি করে আসছে, মশক নিধনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। গত ১৩ বছরে মশক নিধন খাতে ১৫ কোটি ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭ টাকা খরচ করে সংস্থাটি। এর মধ্যে বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর মেয়াদে ইতোমধ্যে ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এর আগে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের মেয়াদকালে খরচ হয় ৩ কোটি ২৫ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭ টাকা। বাকি অর্থ খরচ হয় আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদকালে। সংস্থাটির ২০১০২০১১ থেকে ২০২৩২০২৪ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানা গেছে।

খরচ হওয়া অর্থের মধ্যে ২০১০২০১১ অর্থবছরে ১১ লাখ ১০ হাজার টাকা, ২০১১২০১২ অর্থবছরে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৭২ হাজার ৬৪২ টাকা, ২০১২২০১৩ অর্থবছরে ৩৫ লাখ ৪৩ হাজার ৫৮৫ টাকা, ২০১৩২০১৪ অর্থবছরে ১ কোটি ৪২ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬০ টাকা ব্যয় হয়। ২০১৪২০১৫ অর্থবছরের বাজেটে মশক নিধন খাতে কোনো ব্যয় দেখানো হয়নি। পরে ২০১৫২০১৬ অর্থবছরে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ২০১৬২০১৭ অর্থবছরে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ২০১৭২০১৮ অর্থবছরে ১ কোটি টাকা ১০ লাখ টাকা, ২০১৮২০১৯ অর্থবছরে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১৯২০২০ অর্থবছরে ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ২০২০২০২১ অর্থবছরে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা, ২০২১২০২২ অর্থবছরে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা এবং ২০২২২০২৩ অর্থবছরে খরচ হয় ৯০ লাখ টাকা। এছাড়া চলতি ২০২৩২০২৪ অর্থবছরে একই খাতে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এদিকে সাধারণ লোকজন প্রশ্ন তুলছেন, প্রতি বছর কোটি টাকার বেশি খরচের পরও মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না কেন? অনেক এলাকার লোকজন কীটনাশক ছিটাতে দেখেন না বলেও দাবি করেছেন।

চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরফুল ইসলাম মাহী আজাদীকে বলেন, আমরা নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে প্রতিদিন কীটনাশক ছিটাচ্ছি। এক্ষেত্রে রুটিন ওয়ার্কের সঙ্গে বিশেষ টিমও কাজ করছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও ফলো করছি। সচেতনামূলক কার্যক্রমেও জোর দিচ্ছি আমরা। চার থেকে পাঁচ মাসের লার্ভিসাইড (মশার লার্ভা মারার কীটনাশক) ও আড়াই থেকে তিন মাসের এডাল্টিসাইড (পূর্ণাঙ্গ মশা মারার ওষুধ) মজুদ আছে।

এদিকে চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ শাখা সম্প্রতি প্রজননস্থল হিসেবে ৪৩৩টি মশার হটস্পট চিহ্নিত করে। এছাড়া ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে এমন এলাকাগুলোকে ভিত্তি করে আরো ৫৭টি হটস্পট চিহ্নিত করে। সর্বশেষ গত মাসে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তরের জরিপে দেখা যায়, নগরের ৩০ শতাংশ বাসাবাড়িতে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভা রয়েছে। এছাড়া ২১টি ওয়ার্ডে মশার ঘনত্ব বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ শতাংশ।

বিশ্ব মশা দিবস আজ : ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট ম্যালেরিয়ার সঙ্গে মশার সম্পর্ক আবিষ্কার হয়। এর আবিষ্কারক রোনাল্ড রস। দ্য লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের উদ্যোগে ১৯৩০ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দিনে বিশ্ব মশা দিবস পালন করে আসছে। মশাবাহিত রোগের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে আজ সকাল সাড়ে ১১টায় চসিক নগরের চান্দগাঁও বি ব্লক মসজিদের সামনে থেকে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রওশন এরশাদের সাক্ষাৎ
পরবর্তী নিবন্ধনিউইয়র্ক সিনেটে ‘বাংলাদেশি অভিবাসী দিবস’ প্রস্তাব পাস