খাগড়াছড়ির দ্বিতীয় প্রধান নদী মাইনী। ত্রিপুরা রাজ্যের লংতরাই পর্বত ও লুসাই পর্বতসহ অসংখ্য পাহাড়ি ছড়ার স্রোতধারা মিলে এই নদী সৃষ্টি হয়েছে। দীঘিনালা উপজেলার পূর্বভাগে প্রবাহিত হয়ে লংগদু হয়ে কাপ্তাই লেকে মিশেছে মাইনী। লেকের সাথে নদীর মিলনস্থল ‘মাইনী মুখ’ হিসেবে পরিচিত। গড়ে উঠেছে জনপদও।
মাইনী নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১০৯ কিলোমিটার। অতীতের মাইনী অববাহিকায় ত্রিপুরা জাতির রিয়াংগণের আবাসস্থল ছিল। এর উর্বর উপত্যকায় প্রচুর ধান উৎপাদন হতো বলে নদীর নাম হয়েছে মাইনী। ত্রিপুরা ‘মাইনী হা্’ শব্দের অর্থ ‘ধানের দেশ’। ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য ১৬৬২ সাল থেকে ১৬৬৪ সাল পর্যন্ত মাইনীর তীরে নির্বাসন জীবন কাটিয়েছিলেন।
হারিয়েছে প্রাচুর্য : এক সময়ের যৌবনবতী মাইনী এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। নাড়াইছড়ি, বাবুছড়া, ধনপাতা, বড়াদাম, দীঘিনালা, মেরুংসহ একাধিক জনপদ মাইনীর তীরে গড়ে উঠেছে। মাইনী উপত্যকায় গড়ে উঠেছিল শস্যভান্ডার। ধান, বাদাম, পানের বরজ, মিষ্টি আলু, ভুট্টাসহ বাহারি সবজির আবাদ হতো। কিন্ত এখন চর জেগে ওঠায় এসব চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মাইনী এখন শীর্ণ। শুষ্ক মৌসুমে নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে চাষাবাদ করেন স্থানীয়রা। কমে গেছে নদীর পানিপ্রবাহ। বিশেষত বাবুছড়া থেকে মেরুং পর্যন্ত নদীর নাব্যতা হারিয়েছে সবচেয়ে বেশি। অতীতে এই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বাণিজ্য। দীঘিনালা মেরুং হয়ে রাঙামাটির লংগদু পর্যন্ত নিয়মিত নৌপথে যোগাযোগ ছিল। নদীর গভীরতা ছিল। নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে দুই দশকের বেশি সময় আগে। কেবল উপজেলার মেরুং বাজারের সাথে এখনো মাইনীতে নৌ যোগাযোগ রয়েছে। আর শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে নৌ চলাচল বন্ধ থাকে।
উপজেলার বাবুছড়া এলাকার ব্যবসায়ী মুজিবুল আলম জানান, এক সময় নাড়াইছড়ি থেকে বিপুল সংখ্যক বাঁশ ছালি নদীপথে রাঙামাটি ও কাপ্তাই যেত। কিন্ত পানির স্বল্পতায় তা বন্ধ হয়ে গেছে। বাবুছড়া পর্যন্ত বাঁশের ছালি আসার পর তা সড়কপথে পরিবহন করা হয়। নদীর বুকে চর থাকায় বাঁশ পরিবহন বন্ধ ছিল। এখন ব্যবসায়ীরা সড়কপথে বাঁশ পরিবহন করেন।
যেভাবে ভরাট হচ্ছে মাইনি : মাইনী নদী ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পলি ও চরের কারণে হারাচ্ছে নাব্যতা। জানা যায়, মাটির ক্ষয় বাড়ার কারণে নদীর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পাহাড় কাটা ও জুম চাষের কারণে মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি পেয়েছে। জুমে আদা, হলুদ ও কচু চাষ করার কারণে মাটির ক্ষয় কয়েক গুণ বেড়েছে। পাহাড়, ছড়া হয়ে এসব মাটি নদীতে আসে। এছাড়া বালু, মাটি ও ময়লায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীর তলদেশ। নদীতে জেগে উঠেছে চর। প্রতি বছর নদী ভরাট হলেও খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বর্ষায় ভয়াল : শুষ্ক মৌসুমে নদীটি মরা থাকে। কিন্তু বর্ষার শুরুতে এই নদীতে থাকে তীব্র স্রোত। নদী খনন ও ভাঙন রোধে কোনো উদ্যোগ না থাকায় বর্ষা এলেই আতংক শুরু হয়। প্রতি বছর প্লাবিত হয় দীঘিনালার কবাখালি, হাচিনসনপুর, পুরাতন বোয়ালখালী বাজার, মধ্য বোয়ালখালী, সোবাহানপুর, মেরুং বাজারসহ প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রাম। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির কারণে মাইনীর দুই কূল বন্যায় প্লাবিত হয়। নাব্যতা সংকটে বর্ষায় একাধিকবার নদী তীরবর্তী জনপদ প্লাবিত হয়।
স্থানীয়দের দাবি, নদীর গভীরতা কম হওয়ার পানির প্রবাহ কম থাকে। এতে দ্রুত নদীতীরের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়। নদীর কারণে বছরের পর বছর দুর্ভোগ পোহালেও তা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বর্ষা মৌসুমে অন্তত তিন থেকে চারবার মেরুং ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়।
মেরুং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রহমান কবির রতন বলেন, প্রতি বছর আমাদের ইউনিয়নের ত্রিশটি গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে মৌসুমি সবজির ক্ষেত ডুবে যায়, বাজারেও পানি ঢোকে। স্থানীয় বাসিন্দারা বিদ্যালয় ও বাজারের বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেয়। পানি বাড়লে বাজারের রাস্তা ডুবে যায়। তখন নৌকা দিয়ে মানুষজন পারাপার করে। মেরুং বাজার প্লাবিত হলে লংগদুর সাথে খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। প্রতি বছরই বন্যা হয় বলে জানান তিনি।
নদীর খনন কার্যক্রম : মাইনী নদীতে কখনো খনন কাজ করা হয়নি। খনন না হওয়ার খেসারত দিচ্ছে নদীতীরের বাসিন্দারা।
পরিবেশবাদীদের দাবি : এক সময় পার্বত্য এলাকায় নদী ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি নৌ চলাচলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্ত আগের সেই নদী এখন আর নেই। ফলে নদী তার স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। নদীগুলোকে বাঁচাতে দ্রুত খননের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনে সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী।
যা বলছে পাউবো : খাগড়াছড়ি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (অ.দ) নুরুল আফসার বলেন, চেঙ্গী ও মাইনী নদীর উপর জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। এই দুই নদীকে পূর্বের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার পাশাপাশি রাঙামাটির নানিয়ার চর, মহালছড়ি, দাঁতকুপিয়া, কমলছড়ি হয়ে নদী খনন, চর কাটিং, একটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করার জন্য প্রায় ৬৪০ কোটি টাকার কাজ করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। করোনার কারণে বাস্তবায়নে একটু সময় লাগছে।