বর্তমান সময়ে ‘মব জাস্টিস’ নামের এক বিভ্রান্তিকর ও ভ্রান্ত শব্দের ব্যবহার ক্রমেই ভাইরাল হয়ে উঠেছে। অনেকে একে চমৎকার অভিব্যক্তি মনে করে ব্যবহার করছেন, এমনকি বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও পাবলিক ফিগাররাও। কিন্তু ‘জাস্টিস’ মানে ‘ন্যায়বিচার‘, আর ন্যায়বিচারের সাথে ‘মব ভায়োলেন্স’ বা ‘মব লিঞ্চিং’–এর কোনো সম্পর্ক নেই বরং এই শব্দচয়ন ন্যায় বিচারকে একেবারে অপমানিত, অপদস্ত ও হেয় করে তোলে। ‘মব ভায়োলেন্স’ বা ‘মব ট্রায়েল’ বা ‘মব লিঞ্চিং’ কে ‘মব জাস্টিস’ বলার হেতু কী? ‘জাস্টিস’ কখনো ‘ভায়োলেন্স’ এর সমার্থক হতে পারে না। আর ‘ট্রায়াল’ মানে বিচার। ‘মব ট্রায়েল’ মানে বিচারের নামে প্রহসন আইনের শাসনের প্রতি চ্যালেঞ্জ। উপমহাদেশের প্রথম বিচারিক হত্যাকাণ্ডের নজির নন্দলালের ফাঁসি। ‘মব জাস্টিস ‘ নামে এমন ভুল একটা কথা কীভাবে বাজারে চালু হয়ে গেলো আমার বুঝে আসে না। অনেক বুদ্ধিজীবী, বিখ্যাত ব্যাক্তি বা পাবলিক ফিগারকেও দেখছি খুব চমৎকার অভিব্যক্তি ঘটিয়ে বলছেন ‘মব জাস্টিস‘। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়ও এ শব্দের ব্যাপক অপপ্রয়োগ দেখে এ প্রসঙ্গে কিছু না লিখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ‘মব’ শব্দটি সাধারণত ‘ভিড়’ বা ‘জনতা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ‘মব’ শব্দটি নিজেই একটি নেতিবাচক ধারণা বহন করে একটি বেপরোয়া, বেআইনি ও উচ্ছৃঙ্খল জনতা বুঝায়। তারা বিচারকার্য সম্পাদনের মতো দায়িত্ব পালন করে না, বরং আইন নিজ হাতে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা, শারীরিক নির্যাতন কিংবা মানসিক নিপীড়ন করে। সংবিধানের ৭নং আর্টিকেলে সার্বভৌম জনগণ বা ‘ইউনাইটেড পিউপিল’ বলতে যা বুঝায় এটা তা নয়। এ পিউপিল ইউনাইটেড শেল নেভার ডিফিটেড। এটা হলো কোনো সফল বিপ্লবের নাম। যেমন চব্বিশের ছাত্র জনতার সফল বিপ্লব। আর মব প্রাকটিস মানে হলো উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক বিচার। যা আইনের শাসন ও সুশাসনের বিপরীত বা প্রতিবন্ধক।
তাই ‘মব জাস্টিস’ নয় এটি ‘মব ক্রাইম’ কিংবা ‘মব টেরর’ হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, ‘মব জাস্টিস’ শব্দটি শব্দচয়নের এক ভয়াবহ অপব্যবহার, যা আসলে ‘জাস্টিস’ শব্দটির প্রকৃত মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। ‘মব জাস্টিস’ নয়, এটি ‘মব লিঞ্চিং’, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’, ‘আইনহীনতা’ একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন বুঝায়। মানবাধিকার এর এমন চরম লংঘন আর কিছু হতে পারে না। এটাকে বিচারবহির্ভূত হত্যার, মিডিয়া ট্রায়েল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং, যৌন হয়রানি এ–সব এক একটি মানবাধিকার এর চরম লংঘনের উপাদান। এগুলো সমূলে উৎখাত করতে না পারলে সকল সংস্কার কর্ম ব্যর্থ হবে। মানবতা ও মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকট সৃষ্টি হবে। আইন হাতে নিয়ে অনেক পাগল প্রতিবন্ধী নারীকে ছেলে ধরা অপবাদ দিয়ে গণপিটুনিতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও কম নয়। বিপ্লব পরবর্তী পরিস্থিতির সূযোগ নিয়ে ব্যক্তিগত শক্রুতা হাসিল করা, জায়গা জমি দখল করা এসব মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও দেখেছি, এখনো দেখছি। প্রশাসনকে সচল করতে বিলম্বের সুযোগে সূযোগ সন্ধানীরা এসব করে। তাই প্রশাসনের নির্লিপ্ততা এসব সূযোগ সন্ধানীদের পোয়াবারো হয়। বেআইনী জনতাকে আইনের ভাষায় আনল’ফুল এসেম্বলি বলে। এটা শান্তিপূর্ণ –সমাবেশ এর বিপরীত। আইনের চোখে ‘মব’ কী জেনে নিই। বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, বেআইনি জনতা গঠন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তি যদি কোনো বেআইনি কাজ করার উদ্দেশ্যে একত্র হয়, তাকে ‘Unlawful Assembly’ বলা হয়।এটা ফৌজদারী অপরাধ। পাঁচ বা ততোধিক অবৈধ জনতা গঠন বন্ধ করতে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করতে পারে। ধর্তব্য অপরাধের জন্যে ৫৪ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের বিধানও সিআরপিসিতে রয়েছে। এজাহারভুক্ত ফেরারী বা ঘোষিত আসামী, ফেরারী আসামী বা ধর্তব্য অপরাধ সংগঠনকালে সাধারণ জনগণও কোন অপরাধীকে পাকড়াতে বা গ্রেফতার করতে পারে। বাংলাদেশের আইনে জনগণ কর্তৃক অপরাধী গ্রেফতারের সুযোগ রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, সাধারণ মানুষও কোনো চিহ্নিত অপরাধীকে গ্রেফতার করে আইনের হাতে তুলে দিতে পারে, যদি সেই অপরাধটি গুরুতর হয় বা অপরাধী একজন ঘোষিত অপরাধী হয়। তবে আটক ব্যাক্তিকে নিজ হেফাজতে রেখে দেয়া কিংবা তাকে শারীরিক নির্যাতন নিপীড়ন চালানো ফৌজদারি অপরাধ। এ ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করা যায় যদি আটককৃত অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক কেউ আক্রান্ত হয়। তবে এ অধিকার অত্যন্ত সীমিত। আত্মরক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই প্রয়োগযোগ্য। ‘ন্যায়বিচার’ হয় আদালতে, জনতার হাতে নয়। মব ভায়োলেন্স আসলে একটি বর্বর ও বেআইনী বিচার প্রক্রিয়ার ছায়া। যেখানে প্রমাণ, যুক্তি, আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার এসবের কোনো মূল্য নেই। অথচ ন্যায়বিচার মানে নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনাল, নিরপেক্ষ শুনানি, সাক্ষ্য প্রমাণের মূল্যায়ন ও নির্দোষের সুযোগ। ‘মব ট্রায়াল’ বা ‘মব রুল’ তাই আইনের শাসনের বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ। এটি রাষ্ট্র, সমাজ এবং মানবাধিকারের চরম ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ। আইন শাসনের হীনতা ও প্রশাসনের নির্লিপ্ততা অপরাধীদের বিরুদ্ধে এক প্রকার জনরোষের সৃষ্টি করে।
তাই আইনকে হাতে তুলে নেয়ার প্রবনতা সৃষ্টি হয়। তবে এধরণের খারাপ কাজকে এ অজুহাতে বৈধতা দেয়া যায় না। মব প্রাকটিস এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। মব ম্যান্টেলিটি বা ক্রাউড ম্যন্টেলিটিকে কখনো প্রশ্রয় দেয়া যায় না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও আইন আদালত বিচার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কোন খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে আইনকে হাতে তুলে নেয়া কখনো মেনে নেয়া যায় না। বিশৃঙ্খল জনগোষ্ঠীর বিচার, মব জাস্টিস বা মব রুল বা মবোক্রেসি বা ওখলোক্রেসি একটি অবজ্ঞাসূচক শব্দ। বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ আসাদুজ্জামান বলেছেন, ‘মবের ঘটনাগুলো বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের অনাস্থা নয়। বরং গত ১৭ বছরের ক্রোধ। তবে এই ক্রোধ সমীচীন নয়। গত শনিবার (৫ জুলাই) ২০২৫ ‘জুলাই আন্দোলনের চেতনা বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এ কথা বলেন। মব সন্ত্রাস বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা নয়। মব যেটা হচ্ছে সেটা এক ধরনের ক্রোধ। গত ১৭ বছর মানুষের মধ্যে পুষে রাখা ক্রোধ। স্বজন হারানোর ক্রোধ; সাড়ে ৪ হাজারের বেশি গণতান্ত্রিক যোদ্ধাদের ক্রসফায়ারে হত্যার ক্রোধ; ৭০০–এর বেশি মানুষকে গুম করার ক্রোধ; ৬০ লাখের বেশি মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা করে আদালতে দাঁড় করানোর ক্রোধ।’ তিনি বলেন, ‘এই ক্রোধ আমরা কখনোই কামনা করি না। এই ক্রোধ অপ্রত্যাশিত, এই ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই ক্রোধ জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে যায় না। এই ক্রোধ যারা দেখাচ্ছেন তাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা নিজেদের সংবরণ করুন। একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বাংলাদেশ গড়ার জন্য জুলাই চেতনাকে ধারণ করে আপনারা এমনভাবে বিচারের দাবি তুলুন, যে দাবি শুনলে বিচার সংশ্লিষ্ট সবাই যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং এদের বিচারের আওতায় আনবেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই তাদের বিচার হওয়া দরকার। তবে নুরুল হুদা যে প্রক্রিয়া মবের শিকার হয়েছেন সেই প্রক্রিয়ায় নয়। আমরা এটা কামনা করি না। এটা আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করতে পারে। আইন প্রয়োগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিলা পদক্ষেপ: একাধিকবার দেখা যাচ্ছে, পুলিশ কোনো মব আক্রমণের সময় সঠিক সময়ে বা যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা রাখছে না। রাজনৈতিক সংলাপ ও বাক স্বাধীনতায় ভীতি: ইন্টেরিম (অন্তর্বর্তী) মন্ত্রিত্ব চাপ দিচ্ছে যে, কিছু মব সংগঠিত হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিরোধীদলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে। বিচারের প্রতি বিশ্বাসহীনতা: সাধারণ জনগণ বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা হারিয়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সমালোচনার বিরুদ্ধে সরাসরি আইন না চালিয়ে মব ভায়োলেন্সকে সমর্থন দিচ্ছে । সেনিম (সাউথ এশিয়ান নেটওর্য়াক অন ইকোনোমিক মডেলিং) এর একটি সমপ্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের ৭১.৫% বলছেন ‘মব’ এখন ‘নিয়মিত’ ঘটনা, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনেই প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশে মব ইস্যু এখন একটি গভীর মানবাধিকার ও আইনি সংকট। মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাওয়া, তথা পুলিশের আশু পদক্ষেপের অভাব, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনবিশ্বাসের অবনতি এই পরিস্থিতির মূল মাথা। তরুণদের মধ্যে উদ্বেগও বেড়েই চলেছে এবং তারা চাইছেন শক্তিশালী আইনি প্রতিকার। সমাধানের পথ হিসেবে প্রয়োজন: বিচারিক তদন্ত ও মামলা ত্বরান্বিত করা; পুলিশের আধুনিকায়ন এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত; জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক প্রতিবাদী মনোভাব গড়ে তোলা। মব ভায়োলেন্স সৃষ্টিকারীরা কারো জন্যে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এরা দেশ জনগণ ও মানবতার শত্রু। একটি নিরপেক্ষ ট্রাইবুনালে বা আদালতে ন্যায় বিচার পেতে সবাই হকদার। পুলিশ প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারলেই মব সন্ত্রাস উঠে যাবে নিশ্চয়। মানবতার জয় হোক।
লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট, সুশাসন ও মানবাধিকার কর্মী এবং মহাসচিব, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন– বিএইচআরএফ ।