‘মন ছোটে রঙে বোনা উপত্যকায়’

কাঞ্চনা চক্রবর্তী | মঙ্গলবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ

স্মৃতিময় দুরবিনে শৈশব ও কৈশোর দেখতে গিয়ে চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে গেল। সুখময় ও রঙিন শৈশব আমার জীবনের শ্রান্তময় শীতল ভোর আর কৈশোর হল রবির আলোয় পুলকিত প্রথম সকাল। শৈশব আর কৈশোরের স্মৃতিগুলি জীবন এ্যালবামের রঙিন পাতায় থরে থরে সাজানো আছে বুকের মনিকোঠায়। আহ্‌ কত মধুময় ছিল সেই দিনগুলি!
আমার জন্ম নোয়াখালীর পৈতৃক বাড়িতে পরানপুর ঠাকুর বাড়িতে। বাবা মার এবং বংশের প্রথম সন্তান হওয়াতে আমার আদর ছিল আকাশচুম্বী। সবার বুকে বুকে ছিলাম। অনেক কাকা ও পিসিদের চোখের মনি হয়ে আজও আছি। আমার জন্মের কিছুদিন পরেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আমার বাবা ইস্ট পাকিস্তান ইন্সুরেন্স কোং তে মেরিন ক্লাইম ডিপার্টমেন্টে কর্মরত ছিলেন। বাবা চট্টগ্রাম শহরে থাকতেন। মা আমাকে নিয়ে মামা বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকতেই লেগে গেল মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোল। বাবা রইলেন শহরে আর আমরা নোয়াখালীর চৌমুহনীর মামা বাড়ীতে। যুদ্ধের সেই কঠিন দিনে বাবার এক বন্ধু যাকে আমরা তাহের কাকু (মুক্তিযোদ্ধা তাহের ভুঁঞা) বলে ডাকি। তিনি আমার দাদু (মার বাবা) সহ মামা বাড়ির অনেককেই নোয়াখালী থেকে নৌকায় করে কুমিল্লা দিয়ে বর্ডার পার করে দিয়েছিলেন। মার মুখে শুনেছি, নৌকা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। মা, মাসি ও মামীরা তখন সবায় উঠতি যুবতী। তার মধ্যে পুরুষ শুধু দুই মামা আর দাদু।এর মধ্যে বাড়তি ঝামেলা ও বিপদ হলাম ছোট্ট শিশু আমি। আমার কান্নার শব্দে বারে বারে সবাই ধরা পড়ে যাবার উপক্রম।তাই মাঝে মাঝে আমাকে মুখ চেপে ধরত। মা শুধু বারে বারে দেখতেন, আমার নিঃশ্বাস ঠিক আছে কিনা?এভাবে কুমিল্লার বাতিসা দিয়ে অনেক কষ্টে সোনামুড়া হয়ে উদয়পুর শরণার্থী শিবিরে পৌঁছাল সবাই। কিন্তু ততদিনে আমি অনেক অসুস্থ হয়ে গেলাম। প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার মত। প্রচণ্ড জ্বর আর ডায়রিয়া যা মূলত অপুষ্টি আর ক্লান্তির ফল। সবাই প্রায় আমার বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। কিন্তু মা-ই একমাত্র ভরসা নিয়ে আমাকে বুকে তুলে নিত। আমার প্রয়াত দাদু শ্রীযুক্ত হীরালাল চক্রবর্তী যিনি বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত সংস্কৃত কাব্যতীর্থ পন্ডিত ছিলেন। তিনি আমার জন্য রিলিফের দুধ আনতেন,তবেই আমার খাওয়া হত।আমি অসুস্থতার জন্য সারাদিনই কেঁদে যেতাম। সবচেয়ে দুঃখজনক হল মা বাবার সাথে কোন যোগাযোগই করতে পারেন নি। তাঁরা একেবারেই বিচ্ছিন্ন ছিলেন। সবাই বাবার দেখা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।এদিকে বাবাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের ক্যাম্পে সার্কিট হাউসে ধরে নিয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার বাবার বড় ভাই, জেঠুমনি যিনি তখন আসামের রেলওয়েতেই কর্মরত ছিলেন। তিনি খবর পেয়েই আমাদের নিতে আসলেন। আর শুরু হল আমাদের জীবনে আরেক যুদ্ধ। জেঠীমা আমাদের উপর শুরু করলেন নির্যাতন। সহজ সরল জেঠু এর কোন প্রতিবাদই করতে পারলেন না। এসব কথা মার মুখে শুনেছি। এখন ভাবি আমার মায়ের জীবনে দুটি যুদ্ধ হয়েছে। একটি মুক্তিযুদ্ধ আর একটি আমাকে বাঁচানোর যুদ্ধ। এভাবে সীমাহীন কষ্টে কখনও খেয়ে আবার কখনও না খেয়ে কেটেছে মায়ের সেই কঠিন সময়। আর বাবাকে দেখার প্রতীক্ষা। মার এই কঠিন সময়ে তাঁর সাথে একমাত্র সাথী ছিলেন আমার বড় পিসি। বাবা উর্দু জানাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাবাকে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দিলেন। বাবা ছাড়া পেয়েই মাকেও আমাদেরকে আনতে ইন্ডিয়া গেলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশে ফিরে আমাদের নিয়ে বাবা নোয়াখালীর পরানপুর বাড়িতে চলে এলেন। সেখানেই আমার স্মৃতিমধুর শৈশব কেটেছে।
একদিন আমাকে শহরের স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য চলে আসতে হল। আমরা তিন বোন ও এক ভাই। বাবাকে আমরা বাবু বলেই ডাকি। শহরে এসে নন্দনকানন কৃষ্ণ কুমারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। আমি আর আমার পিঠাপিঠি ছোট বোন একই সাথে একই শ্রেণিতে পড়তাম। সকালে সবাই মিলে একসাথে দল বেঁধে স্কুলে যেতাম। কত সাধারণ ছিল আমাদের সেই সব দিন। আহা কী যে আনন্দময় ছিল দিনগুলো! আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন প্রীতি সেন, তিনি আজ প্রয়াত। তাঁকে আমার বড় দিদিমনি বলে ডাকতাম। গীতা দিদিমনিকে আমরা ভয় পেতাম। সেই ভয় ছিল অনেক সম্মানের। এছাড়া শান্তি স্যার আমাকে যিনি এখনও তাঁর স্নেহ ও ভালবাসায় সিক্ত করেন।তিনি আমাদের অংক পড়াতেন।এছাড়াও স্কুল জীবনের সকল শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমন্ডলী যাদের শিক্ষা ও দিক নির্দেশনায় আজ জীবনে আলোকিত পথ দেখতে পেয়েছি তাঁদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। স্কুলই আমার জীবনে শিকড়। শৈশব যদি হয় সোনার কাঠি, কৈশোর ছিল আমার জীবনে রূপার জীয়ন কাঠি। আহা তখনকার সময়ে আমাদের সাথে শিক্ষকদের শুধুমাত্র স্নেহ, ভালবাসার নয় সম্মান ও আত্মিক এক বন্ধনও ছিল। আমরা তখন কোন কোচিং সেন্টারে পড়তাম না। শ্রেণির পাঠেই আমাদের পড়া আয়ত্ত হত। আর আজ শৈশব ও কৈশোর বন্দি হয়েছে কোচিং সেন্টারের ছোট্ট রুমে। শুধু পড়া আর পড়া। একটি সুখকর স্মৃতি এখনও মনে আছে। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। স্কুলে মেট্রিক পরীক্ষার্থীদের বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান। গীতা দিদিমনি ও অর্পিতা দিদিমনি আমাদের কয়েকজনকে ডেকে বললেন, ডাকঘর নাটকটি মঞ্চস্থ করবেন। যেই কথা সেই কাজ। অল্প কয়েক দিনেই আমরা তৈরী হয়ে গেলাম। আমি পেলাম অমলের চরিত্র। কিছুই জানি না। তবুও সবাই চেষ্টা করলাম সবটুকু দিয়ে। আমরা তখন জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম। বাবা মা-রা বলতেও পারতেন না। স্কুলের দিদিমনিরা আমাদের নিয়ে যেতেন। যখন পুরস্কার নিয়ে ফিরতাম তখনই বাবা মা-রা জানতেন। প্রতিটি জাতীয় দিবস আমরা যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করতাম। আমাদের শৈশব আর কৈশোরের সবচেয়ে আনন্দ ও সুখময় স্মৃতি ছিল মহালয়ার দিন। সেই দিন খুব ভোরে বাবা ডেকে দিতেন। কেউ বিছানায় থাকতে পারত না। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে মহালয়া শোনার সেকি আনন্দ! মা খুব ভোরে উঠে ঠাকুর জাগাতেন। আমরা খুব ভোরে আলো ফুটতেই শিউলি কুড়াতে ছুটে যেতাম।এখনও সেই রাঙা বোঁটার ছোঁয়া পাই। পূজা এলো তো নতুন কাপড়ের আনন্দ। বাবু সবার জন্য একই প্রিন্টের গজ কাপড় নিয়ে আসত। আমাদের তিন পিসি আর আমরা তিন বোন। সবাই একই রকম জামা পড়তাম। মা নিজের হাতে সেই জামা সেলাই করতেন। আমাদের চাহিদা ছিল খুবই সামান্য। সেই জামা মানে ফ্রক পেয়ে শুধু তার নতুন গন্ধ শুঁকে দেখতাম। মজুমদার ভবনে হত বড় করে দুর্গাপূজা। ষষ্ঠীর দিনই ছুটে যেতাম ঠাকুর দেখতে।পূজার দিনগুলি কী যে আনন্দে কেটে যেত! আর সন্ধ্যায় ঠাকুর দেখা। দশমীর দিন যথারীতি মন খারাপ। সরস্বতী পূজা ও লক্ষ্মী পূজায় অন্যরকম মজা হত। শুধু পূজা পার্বণ নয় ঈদের দিনগুলিতেও আনন্দের কমতি ছিল না। তাহের কাকুর বাসায় গিয়ে সেমাই খাওয়ার আনন্দই ছিল অন্যরকম।
বাবা আমাদের মনে অসামপ্রদায়িকতার আলো জ্বলে দিয়েছিলেন। আর মা শিখিয়েছেন সৎভাবে কিভাবে জীবনের পথ চলতে হয়।একটি ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে আছে। আমি তখন সবে স্কুলে পড়ি। বড়রা সবাই চুপি চুপি কথা বলছে। বাবার মন খারাপ আর মা নিঃশব্দে কাঁদছেন। বড় হয়ে বুঝলাম, সেই দিনটি ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। ১৯৮৬ সালে আমি এসএস সি পাস করি। আমাদের স্কুল থেকে আমিই একমাত্র প্রথম বিভাগ পাই। সেই দিনটিও স্মরণীয়। সেই সোনালি দিনগুলি এখনও জীবনে আভা ছড়িয়ে যায়। শান্ত দীঘির মত কিশোরীবেলা। সেখানে শুধু আজ আপন মনে সাঁতার কেটে যাই। কূলে ভিড়ে দেখি স্মৃতি সতত মধুর। কিশোরীবেলা যেন ফেলে আসা গোধূলি বেলার এক চিলতে আলো। ফেলে আসা দিনগুলি যেন স্মৃতির অ্যালবামে সাজানো ছবি।
লেখক : প্রাবন্ধিক; বিভাগীয় প্রধান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, নিজামপুর সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীদের ওপর মানসিক নির্যাতনের জন্য নারীরাই অধিকাংশে দায়ী
পরবর্তী নিবন্ধস্মরণ : নিভৃতচারী সমাজব্রতী মোহাম্মদ মোসলেহ্‌ উদ্দিন এফসিএ