দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে পুরনোর সঙ্গে একঝাঁক নতুন মুখ মিলিয়ে নতুন সূচনা করতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দাঁড়িয়েও ভোটের আগে ইশতেহারে সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। ভোটে জয়ের পর তার নতুন মন্ত্রিসভায় মিলছে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তনের আভাস। বিদায়ী সরকারে থাকা প্রবীণ ও বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের অনেকের জায়গা হয়নি নতুন মন্ত্রিসভায়। গতবারের মত এবারও শেখ হাসিনার নতুন মন্ত্রিসভার সবাই আওয়ামী লীগের, শরিক দলের কাউকে তিনি ফেরাননি।
প্রধানমন্ত্রীসহ নতুন মন্ত্রিসভার আকার দাঁড়িয়েছে ৩৭ জনে। তাদের মধ্যে ২৫ জন পূর্ণ মন্ত্রী। আর ১১ জন পাচ্ছেন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠিত হবে। শপথ পাঠ করাবেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। নতুন সরকারে কে কোন মন্ত্রণালয় পাবেন, তা জানা যাবে দপ্তর বণ্টনের পর। নতুন মন্ত্রিসভায় যে ৩৬ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে তাদের মধ্যে ১৪ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী প্রথমবারের মতো দায়িত্ব পাচ্ছেন। একেবারেই এসব নতুন মুখের পাশাপাশি এর আগে বিভিন্ন সময় মন্ত্রিসভায় থাকা আরও চারজনকে ফিরিয়ে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী। খবর বিডি/বাংলানিউজের।
নতুন সরকারের অর্ধেকের বেশি মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রী প্রথমবারের মতো সরকারের দায়িত্ব পালন করতে আসছেন। বিদায়ী সরকারে থাকা ১৫ মন্ত্রী এবং ১৩ প্রতিমন্ত্রী এবং দুই জন উপমন্ত্রীর নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান হয়নি।
নতুন মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের মধ্যে ২৫ জন পূর্ণমন্ত্রী হলেন– আ, ক, ম, মোজাম্মেল হক (গাজীপুর–১), ওবায়দুল কাদের (নোয়াখালী–৫), নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন (নরসিংদী–৪), আসাদুজ্জামান খান (ঢাকা–১২), ডা. দীপু মনি (চাঁদপুর–৩), মো. তাজুল ইসলাম (কুমিল্লা–৯), মুহাম্মদ ফারুক খান (গোপালগঞ্জ–১), আবুল হাসান মাহমুদ আলী (দিনাজপুর–৪), আনিসুল হক (বাহ্মণবাড়িয়া–৪), মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ (চট্টগ্রাম–৭), মো. আব্দুস শহীদ (মৌলভীবাজার–৪), সাধন চন্দ্র মজুমদার (নওগাঁ–১), র, আ, ম, উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী (ব্রাহ্মণবাড়িয়া–৩), মো. আব্দুর রহমান (ফরিদপুর–১), নারায়ন চন্দ্র চন্দ (খুলনা–৫), আব্দুস সালাম (ময়মনসিংহ–৯), মহিবুল হাসান চৌধুরী (চট্টগ্রাম–৯), ফরহাদ হোসেন (মেহেরপুর–১), মো. ফরিদুল হক খান (জামালপুর–২), মো. জিল্লুল হাকিম (রাজবাড়ী–২), সাবের হোসেন চৌধুরী (ঢাকা–৯), জাহাঙ্গীর কবির নানক (ঢাকা–১৩), নাজমুল হাসান (কিশোরগঞ্জ–৬), স্থপতি ইয়াফেস ওসমান এবং সামন্ত লাল সেন।
১১ জন প্রতিমন্ত্রী হলেন– বেগম সিমিন হোমেন রিমি (গাজীপুর–৪), নসরুল হামিদ (ঢাকা–৩), জুনাইদ আহমেদ পলক (নাটোর–৩), মোহাম্মদ আলী আরাফাত (ঢাকা–১৭), মো. মহিববুর রহমান (পটুয়াখালী–৪), খালিদ মাহমুদ চৌধুরী (দিনাজপুর–২), জাহিদ ফারুক (বরিশাল–৫), কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা (খাগড়াছড়ি), বেগম রুমানা আলী (গাজীপুর–৩), শফিকুর রহমান চৌধুরী (সিলেট–২) এবং আহসানুল ইসলাম টিটু (টাঙ্গাইল–৬)।
এই তালিকা বলছে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব পালন করা পাঁচজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীকে নতুন মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেষ হাসিনা। বিষয়টিকে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর ইংগিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বয়স আর অসুস্থতার কারণে গত দুবার বাজেট দেওয়ার সময় যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। তার দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। তাদের দুজনের কেউই থাকছেন না নতুন মন্ত্রিসভায়। গত পাঁচ বছর দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীদের মধ্যে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক, পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও নতুন মন্ত্রিসভায় থাকছেন না।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পরও প্রধানমন্ত্রীর পর ২৫ জন পূর্ণ মন্ত্রীর শপথ হয়। এদের মধ্যে দুইজন ছিলেন টেকনোক্র্যাট কোটায়। এবারের জাতীয় নির্বাচনের আগে পদত্যাগ করেন তারা। ফলে গতকাল বুধবার পর্যন্ত মন্ত্রী হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন যে ২৩ জন, তাদের মধ্যে কেবল ৯ জন নতুন সরকারে থাকছেন।
নতুন সরকারের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে ১৪ জন একেবারে নতুন। বিদায়ী সরকারে না থাকলেও আগে মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করেছেন এমন চারজনকে শেখ হাসিনা ফিরিয়ে এনেছেন পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে। এছাড়া গত সরকারের দুইজন উপমন্ত্রী এবং একজন প্রতিমন্ত্রী এবার পদোন্নতি পেয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। শেখ হাসিনার গত সরকারে অনির্বাচিত (টেকনোক্র্যাট) মন্ত্রী ছিলেন দুজন, তাদের মধ্যে একজনকে এবারও সরকারে রাখা হয়েছে। এর বাইরে টেকনোক্র্যাট হিসেবে মন্ত্রীর দায়িত্বে এসেছেন আরো একজন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত মন্ত্রিসভায় তিন জন উপমন্ত্রী থাকলেও এবার কাউকে উপমন্ত্রী রাখা হয়নি।
এক সময়ের উপমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীকে পূর্ণ মন্ত্রিত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়েছেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এবং পরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এই ব্যবসায়ী ও ক্রীড়া সংগঠক। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা সাবের চৌধুরী ২০১৪ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদে আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়নের (আইপিইউ) প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৯৬–২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি ছিলেন সাবের।
২০০৮–২০১৩ মেয়াদে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার ১০ বছর পর জাহাঙ্গীর কবির নানককে পূর্ণ মন্ত্রিত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান নানক বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে নতুন করে মন্ত্রিসভায় আনা হয়েছে। নতুন মন্ত্রিসভায় চমক হিসেবে এসেছে বাংলাদেশে দগ্ধ রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে পরিচিত নাম অধ্যাপক ডা. সামন্তলাল সেনের নাম। টেকনোক্র্য্যাট কোটায় পূর্ণ মন্ত্রী হয়েছেন দেশের বার্ন ইনস্টিটিউটগুলোর জাতীয় এই সমন্বয়ক।
২০১৪ থেকে পাঁচ বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে আবারও মন্ত্রিসভায় ফেরানো হয়েছে। ২০০৯ সালের সরকারে বাণিজ্যমন্ত্রী এবং বিমান পরিবহনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ফারুক খানকে ১০ বছর পর আবারও মন্ত্রিসভায় ফিরিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গত পাঁচ বছর শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা তরুণ নেতা মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে পূর্ণমন্ত্রী করছেন প্রধানমন্ত্রী।