নগরে ‘মাস র্যাপিড ট্রানজিট’ (এমআরটি) সার্ভিস চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) আগামী ছয় মাসের মধ্যে শেষ হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ট্রাফিক ডাটা সার্ভে এবং রুট সিলেকশনের স্টাডিও শেষ হয়েছে। এক্ষেত্রে এমআরটির দুটো অংশ অর্থাৎ মেট্রোরেল এবং মনোরেল উভয়ের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শহরের এমআরটি রুটের সঙ্গে মীরসরাই ইকোনমিক জোন এবং আনোয়ারা ইকোনমিক জোনকে সম্পৃক্ত করেই চলছে এ সম্ভাব্যতা যাচাই। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিআরসিসি), উইহায় ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেটিভ কোম্পানি লিমিটেড (উইটেক) এবং সিআইটিআইসিসি। সিআরসিসি এবং উইটেক এর সঙ্গে গত ২২ মার্চ এমওইউ করেছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এর প্রেক্ষিতে বিনামূল্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানগুলো। এর আগে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘বাসস্থান ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনসালটেন্ট লিমিটেড’ দিয়ে প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল চসিক।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, নগরে মেট্রোরেলের চেয়ে মনোরেল বাস্তবায়নের সম্ভাবনা বেশি। সম্ভাব্যতা যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, চসিকের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে লালখান বাজার-বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়ক রয়েছে। সেখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ চলছে। ফ্লাইওভারের যে কলামগুলো হচ্ছে তার একেকটার লেন্থ আড়াই মিটার-তিন মিটার। কিন্তু মনোরেলে লাগবে শূন্য দশমিক আট থেকে এক দশমিক দুই মিটার। তার মানে অনেক ছোট। তাছাড়া এটা অনেক উঁচুতে নেয়া যাবে। এ রুটে অনেক ভবন আছে, নানা প্রতিবন্ধকতা থাকবে। তবে মনোরেলের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়েও এর ট্র্যাকটা যেতে পারবে। তবে শেষ পর্যন্ত সরকারই সিদ্ধান্ত দিবে মনোরেল নাকি মেট্রোরেল হবে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম শহরে এমআরটি চালুর বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলন কক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম চট্টগ্রামে এমআরটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে মন্ত্রণালয়ের আগ্রহের কথা জানান। ওই সভায় সিআরসিসি এবং উইটেক এমআরটি নিয়ে একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। সভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাদের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়ার নির্দেশনা দেন। পরবর্তীতে ১৯ জনুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে চসিককে সিআরসিসি এবং উইটেক এর সাথে এমওইউ করার সম্মতি দেয়।
এদিকে গতকাল বুধবার টাইগারপাসস্থ নগর ভবনের অস্থায়ী কার্যালয়ে এসে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি দল তাদের কাজের অগ্রগতি বিষয়ে অবহিত করেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে। এসময় মেয়র নগরীর সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রেখে এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে সেখানে ভূগর্ভে রেল লাইন স্থাপনে গুরুত্ব দিয়ে সমীক্ষা কাজ পরিচালনা করতে প্রতিনিধি দলের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম শহরে জন ও পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা আমাদের গড়ে তুলতে হবে। এখানে সড়ক, ফ্লাইওভার, ওভারপাস, ব্রিজ, টানেল আছে। এগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে জনগণের চলাচল সহজ করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য। সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন মেয়র। এ সময় সিআরসিসি এর পরিচালক হুচাউ বলেন, এমআরটি নিয়ে আমাদের দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, চায়না প্রতিষ্ঠানগুলোর তাদের কাজের অগ্রগতি বিষয়ে জানিয়েছে। তারা মেট্রোরেল এবং মনোরেল দুটো নিয়েই সমীক্ষা করছে। ইতোমধ্যে তারা থিউরিক্যাল কাজ শেষ করেছে। এখন ফিল্ড ওয়ার্ক শুরু করবে। রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিআরসিসি) এবং উইহায় ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেটিভ কোম্পানি লিমিটেড এর কান্ট্রি প্রতিনিধি আবিদ রহমান তানভীর আজাদীকে বলেন, গত মার্চে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে আমরা এমওইউ করছিলাম। মাঝখানে চীনের মধ্যে আবারো করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল এবং সেখানে লকডাউনের আলোচনাও হয়। ওই কারণে কিছুটা আমরা পিছিয়ে পড়ি। কিন্তু সেটা এখন রিকভার হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ট্রাফিক ডাটা সার্ভে এবং রুট সিলেকশনের স্টাডিও শেষ হয়েছে। আশা করছি ছয় মাসের মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হবে। অবশ্য আমাদের দেড় বছর সময় দেয়া হয়েছে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, এমআরটি বিষয়ে ২০১৯ সালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘বাসস্থান ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনসালটেন্ট লিমিটেড’ দিয়ে প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল চসিক। একই বছরের জুলাই মাসে চসিকের কাছে হস্তান্তরকৃত প্রতিবেদনে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি জানায়, নগরে ৫৪ দশমিক ৫০ কিলোমিটার রুটে পৃথক তিনটি এমআরটি সার্ভিস চালু করা সম্ভব। বর্তমানে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করা চায়না প্রতিষ্ঠান সিআরসিসি এবং উইটেক তাদের সমীক্ষায় ‘বাসস্থান ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনসালটেন্ট লিমিটেড’ এর প্রস্তাবিত তিনটি রুটের উপর জোর দিচ্ছে। একইসঙ্গে শহরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টকে সম্পৃক্ত করা হবে। পাশাপাশি মীরসরাই ও আনোয়ারাসহ নিকটতম উপজেলাগুলোকে সম্পৃক্ত করবে।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চীনের চারটি প্রতিষ্ঠান নগরে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে মনোরেল ও মেট্রোরেল চালুর প্রস্তাব করে। তবে এমআরটি চালু বা এ সংক্রান্ত আরো অধিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ঢাকার পর চট্টগ্রামেও মেট্রোরেল চালুর নির্দেশ’ দেয়ার পর তৎপরতা শুরু করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এছাড়া চীনের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি সিডিএকে নগরে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি প্রস্তাব দেয়। তারা বিনামূল্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায়। বিনিময়ে মীরসরাইয়ের কাছে সাগর থেকে উদ্ধার করা জমিতে তারা একটি স্মার্ট সিটি বানিয়ে সেখান থেকে লভ্যাংশ আদায় করবে। সর্বশেষ দক্ষিণ কোরিয়া তাদের উন্নয়ন সংস্থা কোইকার মাধ্যমে নগরে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখায়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের উপস্থিতিতে এ বিষয়ে কোইকা প্রতিনিধিরা একটি বৈঠকও করেন।












