মনের চোখ ফোটাতে পারেন একজন শিক্ষক

ড. সাদিকা সুলতানা | বুধবার , ৫ অক্টোবর, ২০২২ at ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীতে একে অপরকে দিয়ে কাজ করানোর একটিমাত্র উপায় আছে, তা হলো কাজটি সম্পর্কে অপরের আগ্রহ জাগিয়ে তোলা, যাতে সে নিজেই কাজটি করতে উদ্বুদ্ধ হয়, কাজটি করতে চায়। আমার শিক্ষাজীবনে আমার মহান শিক্ষকরা আমার প্রাণেমনে শিক্ষকতার বীজ এমনিভাবে প্রোথিত করেছেন, আমার আর অন্যকিছুতে মন লাগে না। নিদ্রায় দেখিনু এক মধুর স্বপন, কি সুন্দর মেলিছিনু আঁখি চমকেনু পুনঃদেখি, কঠোর কর্তব্যরত জীবনযাপন! রবিঠাকুর বলেছেন, ‘শিক্ষার সবচাইতে বড় অঙ্গটা বুঝাইয়া দেয়া নহে, মনের মধ্যে ঘা দেওয়া’ আর এই মনের মধ্যে ঘা দিতে পারেন শুধুমাত্র একজন শিক্ষক। ঘুমন্ত সিংহের মুখে কখনও হরিণ প্রবেশ করে না, তাকে ছুটে গিয়ে শিকার করতে হয়! বিধাতা এই সুন্দর ধরণীর আকাশকে সজ্জিত করেছেন, এক আশ্চর্য সজ্জায়, গ্রহ, নক্ষত্র, তারকারাজি দিয়ে। মানুষ জ্ঞান আহরণ করলে এটাই তার হৃদয়ের লুকানো গুণগুলোকে শক্তি করে তোলে। সূর্যের আলোতে যেরূপ পৃথিবীর সব কিছু ভাস্বর হয়ে উঠে, তেমনি জ্ঞানের আলোতে সেরূপ সব অন্ধকার কেটে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। শিক্ষক হলেন সেই ব্যাক্তি যার আত্না হতে অপর আত্নায় শক্তি সঞ্চারিত হয়। শিক্ষক হলেন সেই ব্যাক্তি যিনি গঠন করেন জাতিসত্তা। শিক্ষকের প্রভাব অনন্তকালে গিয়েও শেষ হয় না! শিক্ষা একজন মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয়, আর যেকোনো শিক্ষাই চর্চা ব্যতীত বলিষ্ঠ হয় না। জ্ঞানের উত্তোরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি চর্চার মাধ্যমেই ঘটে। জ্ঞান কোনো বিশেষ দেশ বা জাতির একচেটিয়া বস্তু নয়। বিতরণের মাধ্যমেই জ্ঞান পূর্ণতা লাভ করে আর শিক্ষক হবেন জ্ঞানী, তার জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমেই তিনি সৃষ্টি করবেন একটি বু্‌দি্ধদীপ্ত জাতি। ‘গুরু যদি এক বর্ণ শিষ্যেরে শেখায় কোনদিন, পৃথিবীতে নাই দ্রব্য যা দিয়ে শোধ দিবে ঋণ’ চাণক্য পণ্ডিত বলেন। শিক্ষাদানের মহান ব্রত যার কাজ তাকেই শিক্ষক বলা হয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ সবধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিতদের শিক্ষক বলা হয়। একজন শিক্ষকই পারেন তার অনুসারীদের জ্ঞান ও দীক্ষা দিতে। শিক্ষার্থীর মানবতাবোধকে জাগ্রত করে একজন শিক্ষক কেবল পাঠদানকেই সার্থক করে তোলেন না, পাশাপাশি দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে, স্বীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদেরকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো শিক্ষাকে তুলনা করেছিলেন অন্ধকার গুহার মধ্যে অজ্ঞতায় শিকলবদ্ধ মানুষের কাছে আলোকরশ্মীর আকস্মিক বিকিরণের সাথে। সেই অর্থে শিক্ষকরা হলেন তিমির অভিসারী ও আলো বিতরণকারী। কেননা জ্ঞানই হচ্ছে প্রকৃত আলো। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা অনেক শিক্ষকের সংস্পর্শে আসি। শিশুর সামাজিকীকরণ এবং ব্যক্তিত্ব গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন শিক্ষক। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক মা বাবার ভূমিকা পালন করেন, কারণ মাতাপিতা অনেকসময় জ্ঞানী বা শিক্ষিত নাও হতে পারেন কিন্তু শিক্ষক মানেই জ্ঞানী অভিজ্ঞ পণ্ডিত। শিক্ষক আমাদের ছোট ছোট অনুভূতিগুলো যেমনিভাবে জাগিয়ে তোলেন তেমনি নৈতিকতা, শিক্ষা, শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, পরিচ্ছন্নতা, দেশাত্ববোধ, সঠিক রাজনৈতিক চেতনার অনুশীলন করার পথ দেখান। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপখাইয়ে কিভাবে সুষ্ঠু ব্যাক্তিত্ব গড়ে উঠবে তার দিকনির্দেশক। শিক্ষক জানেন জীবনের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সহায়তা দান করাই তাঁর প্রধান কর্তব্য। একজন আদর্শবাদী এবং প্রাজ্ঞ শিক্ষক সকল ধরনের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, গোঁড়ামি দূর করে আমাদের করে তোলেন বৈজ্ঞানিক চেতনায় বিশ্বাসী। ধর্মান্ধতা দূর করে জাগিয়ে তুলতে পারেন মানবতা। শিক্ষকের সংস্পর্শেই আমরা শিখি বাংলা, ইংরেজী, অর্থনীতি, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, সংস্কৃতিসহ সকল বিষয়। জ্ঞান সঞ্চারিত হয় এক জেনারেশন থেকে অন্য জেনারেশনে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘গুরু শিষ্যের আত্মার সম্বন্ধের ভেতর ভেতর দিয়াই শিক্ষাকার্য সজীবদেহের শোণিত স্রোতের মত চলাচল করতে পারে। কারণ শিশুদের লালন পালন ও শিক্ষণের যথার্থভার পিতামাতার উপর যে যোগ্যতা বা সুবিধা না থাকাতেই অন্য উপযুক্ত লোকের সহায়তা আবশ্যক হয়ে উঠে। এমন অবস্থায় গুরুকে পিতামাতা না হলে চলে না’। শিক্ষকতাকে একটি সৃজনশীল পেশা বললে অত্যুক্তি হবেনা। শিক্ষকতাকে অভিহিত করা হয়, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এবং মহানতম আদর্শ হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হয়ে সন্তুষ্ট থাকেননি। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তিনি নিজেকে একজন নিবেদিত প্রাণ আদর্শ শিক্ষকে রূপান্তরিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারে অনেকগুলো গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে জ্ঞানের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যা তিনি আয়ত্ব করেননি। গাছ লাগাও, পরিবেশ বাঁচাও, বৃক্ষরোপণ এর প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ আমার স্কুলের শিক্ষকদের সাথে স্কুলমাঠে বাগান করা দিয়েই শুরু, একুশের প্রভাতফেরী কিংবা জাতীয় পতাকার রঙ এর বিশ্লেষণ, বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা, বাংলার গৌরবময় স্বাধীনতার ইতিহাস, নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ সবই শিখেছি শিক্ষকের কাছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘কয়েকটা পাশ দিলে বা ভালো বক্তৃতা দিতে পারলেই তোমাদের কাছে শিক্ষিত হলো, যে বিদ্যার উন্মেষে ইতরসাধারণকে জীবন সংগ্রামে সমর্থ করতে পারা যায় না, সেকি আবার শিক্ষা। যে শিক্ষায় জীবনে নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে পারা যায়, সেই হচ্ছে শিক্ষা। একজন শিক্ষক অবশ্যই জীবনমুখী শিক্ষা দেবেন, যা তার নিত্যদিনের কাজে সে ব্যবহার করবে, আর না হয় তা পুঁথিগত বিদ্যা পরহস্তগত ধনের মতো কোনো কাজে আসবে না। একজন শিক্ষক অবশ্যই জ্ঞানে পরিপূর্ণ এবং অভিজ্ঞ হবেন। যে বিষয়ে তিনি জ্ঞান বিতরণ করবেন, নাম, যশ বা অন্য কোনো খ্যাতি অর্জন যেন তাঁর শিক্ষকতার উদ্দেশ্য না হয়। শিক্ষক হবেন নিরপেক্ষ উদারনৈতিক দর্শনের অধিকারী, সুবচনা, দক্ষ সংগঠক এবং উপস্থাপক। ছাত্রছাত্রীদের প্রতি শিক্ষকের আচরণ হবে সন্তানতুল্য। তাঁর দৃষ্টান্তগুলো হবে বাস্তবধর্মী, জীবনমুখী, এবং বিজ্ঞানভিত্তিক, চমকপ্রদ, আনন্দময়, যুগোপযোগী। শিক্ষকের চমকপ্রদ উপস্থাপনই পারে জ্ঞানের গভীরতম কঠিনতম শাখা সম্পর্কেও ছাত্রদের সহজ প্রবেশ। গল্প, উপন্যাস পড়ার যে রস উত্তম শিক্ষকই পারেন সে রস উপভোগে তাড়িত করতে ছাত্রদের। সকল অজ্ঞানতা দূর করে আলোর দিশা দিতে। শিক্ষক এর অর্থ হলো শি-শিষ্টাচারী, ক্ষ- ক্ষমাশীল, ক- কর্তব্যনিষ্ঠ বা কর্তব্যপরায়ণ। ইংরেজিতে Teacherশব্দের অর্থ এভাবে সাজাতে পারি T- Terrific E-Energetic A-Able, C-Chearful, H-Hardwarking, E- Enthusiatic, R-Remarkable। শিক্ষকই শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণ। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের কথায় শিক্ষকরা হলেন প্রকৃত সমাজ ও সভ্যতার বিবেক। এজন্য শিক্ষকদের বলা হয় সমাজ নির্মাণের স্থপতি। বিধাতা শারীরবৃত্তীয় কাঠামো দিয়ে পাঠিয়েছেন মানুষকে, কিন্তু তার মনের চোখ ফোটাতে পারেন একজন শিক্ষক। এজন্যই বলা হয়, ‘ওস্তাদে প্রণাম করো, পিতা হন্তে বার! দোসর জনম নিল, তিহ সে আক্ষার’ শিক্ষকের সংস্পর্শে মানুষের দ্বিতীয় জন্ম হয়। শিক্ষকতার যে আনন্দ তা এ জগতে আর কিছুতেই নেই তাই জ্ঞান বিতরণ এবং জ্ঞান অন্বেষণের এ পেশায় আমি যতই পুরোনো হচ্ছি, প্রতিদিনই নতুন কিছু জানার স্পর্শে নতুনতর হচ্ছি। আর তাইতো শিক্ষকতা এক চিরতারুণ্যের নাম।
লেখক : শিক্ষক, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ার পারুয়ার সাথে মরিয়মনগর ডিসি সড়কের বিকল্প সংযোগ সড়ক