একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেছেন, পশু–পাখি তাদের নিজস্ব দোষগুণ নিয়ে জন্মায়। শুধু মানুষকেই মানুষ হওয়ার জন্য বহু কষ্ট করতে হয়, নিরন্তর কাজ করতে হয়। ঠিকঠাকভাবে এসব কাজ করতে না পারলে মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েও ঠিক মানুষ হওয়া যায় না। তিনি গতকাল বুধবার দুপুরে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার দাখিল কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখছিলেন।
এম এ মালেক বলেন, জ্ঞানার্জনের কোনো বিকল্প নেই। অন্ধকার দূর করতে যেমন আলোর প্রয়োজন হয়, তেমনি মনের অন্ধকার দূর করতে জ্ঞানের প্রয়োজন। তাই বেশি বেশি করে পড়তে হবে, জানতে হবে। তা না হলে জ্ঞানের পরিধি বাড়বে না। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, জীবনে অনেক সমস্যা, বাধাবিপত্তি আসবে। তারপরও কাজ করে যেতে হবে, লেগে থাকতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই জীবনে সাফল্য অর্জন করতে পারবে।
এম এ মালেক বলেন, জীবনে তিনজন মানুষ কোনোদিনই তোমাদের অকল্যাণ কামনা করবেন না। একজন তোমার বাবা, একজন তোমার মা এবং একজন তোমার শিক্ষক। এই তিনজনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড, আদেশ নির্দেশ সবই তোমাদের কল্যাণে। তাই জীবনে এই তিনজনের অবাধ্য হয়ো না।
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল মহসিন মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সভাপতিত্বে কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন আনজুমান–এ–রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মনজুর আলম, ট্রাস্টের সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, হামদ–নাত পরিবেশনা এবং স্বাগত বক্তব্য দেন অধ্যক্ষ ও সদস্য সচিব আল্লামা কাজী আব্দুল আলীম রেজভী। অনুষ্ঠানে ট্রাস্টের এডিশনাল সেক্রেটারি সামশুদ্দিন, জয়েন সেক্রেটারি জেনারেল সিরাজুল হক, এসিসট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল এস এম গিয়াস উদ্দীন শাকের, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা মাদরাসার গভর্নিং বডির সদস্য মাহমুদ নেওয়াজ, দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার হাসান আকবর, সমাজ সেবক আর ইউ চৌধুরী শাহীন, মাওলানা মুহাম্মদ কামাল উদ্দীন আযহারী, মাওলানা মুহাম্মদ ওমাইর রেজভী, মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাছানাত, মাওলানা মুহাম্মদ হাফেজ আজিজুর রহমান, মাওলানা নঈমুল হক, আহসান হাবীব, মাওলানা জয়নুল আবেদীন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
পরে কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা ও সনদপত্র প্রদান করা হয়। প্রধান অতিথির বক্তব্যে এম এ মালেক আরো বলেন, আমার বাবা ছিলেন এই দরবারের একনিষ্ঠ খাদেম।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জামেয়া দেশ–জাতির উন্নয়নে ও মাযহাব–মিল্লাত প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। আজকের এই কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনায় উপস্থিত হতে পেরে আমি গর্বিত। দাখিল পরীক্ষার্থীদের
এই সাফল্য জামেয়া প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য–উদ্দেশ্যকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে বলে আমি মনে করি। আশা করি, ভবিষ্যতেও এ সাফল্যের ধারা অব্যাহত থাকবে। জামেয়ার সার্বিক উন্নয়নে আমার সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
এম এ মালেক ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবুল কালাম, নেলসন ম্যান্ডেলা এবং রবার্ট ফ্রস্টের বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণামূলক বিভিন্ন কথা বলেন। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সৎচরিত্রবান ও ভালো মানুষ হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তোমরা নিজেরা যদি ভালো হও, সৎচরিত্রবান হও–তাহলে দেশ ভালো থাকবে, আমরা এগিয়ে যাব। তোমরা চরিত্রবান এবং সৎ হলেই কেবল তোমার প্রতিবেশি বা অন্যদের সৎ ও চরিত্রবান হওয়ার কথা বলতে পারবে। নিজের পরিবারের দিকে খেয়াল রাখা, নিজের পরিবারকে সুন্দর রাখা এবং স্বাবলম্বী করা গেলে দেশ স্বাবলম্বী হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, একটি কলম, একটি বই এবং একজন শিশু পৃথিবীকে পাল্টে দিতে পারে। তোমরা আমাদের পৃথিবী পাল্টে দেয়ার হাতিয়ার হয়ে ওঠো।
এম এ মালেক বলেন, আমাদের প্রত্যেকের জীবনে একটা গল্প আছে। জীবনের পথে হাঁটার গল্প। পেছনে ফিরে গিয়ে গল্পের শুরুটা আমরা কখনো পরিবর্তন করতে পারবো না। কিন্তু চাইলেই গল্পের শেষটা আমরা নিজেদের মত করে সাজিয়ে তুলতে পারি। এর জন্য বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। শুধু দরকার ইচ্ছাশক্তি। তিনি বলেন, আল্লাহ চাইলে আমাদেরকে পেছনেও একটি চোখ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা দেননি। কারণ পেছনে তাকানোর দরকার নেই। পেছনের অভিজ্ঞতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন।
এম এ মালেক বলেন, আমি আশাবাদী মানুষ। যেখানে যাই আশার কথা বলি। স্বপ্নের কথা বলি। আমেরিকার প্রখ্যাত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী লেখিকা হেলেন কেলারের মত আমিও বিশ্বাস করি–আশা হলো এমন একটা জিনিস যা মানুষকে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায়। সত্যিকার অর্থে আশা আর আত্মবিশ্বাস ছাড়া এ পৃথিবীতে কোনো মহৎ অর্জনই সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, হেলেন কেলারকে বিধাতা অন্ধ বানানোতে কোনো ক্ষোভ আছে কিনা জানতে চেয়েছিলেন একজন। তিনি বলেছিলেন, আমি যে পৃথিবীতে আছি, শ্বাস নিচ্ছি এটার ধন্যবাদ দিয়েও তো শেষ করতে পারছি না, অন্ধ বানানোর জন্য অভিযোগ করবো কখন!
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে এম এ মালেক বলেন, আপনাদের প্রত্যেকের মধ্যেই অপরিমেয় সম্ভাবনা আছে। সম্ভাবনার কোনো সীমারেখা থাকে না, সীমারেখা নেই। তাই স্বপ্ন দেখুন। নিজেকে নিজের মত করে গড়ে তোলার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে সত্য করে করে তোলার জন্য ছুটে চলুন। বাধা আসবে, ডিঙিয়ে যাবেন। পথের বাঁকে বাঁকে প্রতিবন্ধকতা থাকবে, পার হয়ে যাবেন। কিন্তু থামবেন না। সব কাজ আমি বা আপনি করতে পারবেন তা ঠিক নয়। কিন্তু কাউকে না কাউকে আরম্ভ করতে হবে। তাহলে অন্যে সেটা শেষ করবে। রাইট ব্রাদার্স বাহুতে লতা পাতা বেঁধে ঝাপ দিয়েছিলেন বলেই আজ আমরা ঘন্টায় এক হাজার কি.মির বেশি বেগের বিমানে উড়ছি। তারা শুরু করেছিলেন বলেই অন্যরা তা অর্জন করতে পেরেছিলেন।
তিনি ভালো ফলাফল করায় শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ জানান এবং ভবিষ্যতেও ভালো ফলাফলের এই ধারা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি আনজুমান–এ–রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মনজুর আলম বলেন, আপনাদের জীবন শুরু হলো মাত্র। এটা মনে রাখতে হবে। ভালো ফলাফল ও শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি মানবিক মানুষ হতে হবে। তোমরা যোগ্য আলেম হয়ে দ্বীন–ধর্ম ও সুন্নিয়তের প্রতিনিধিত্ব করবে। এইতো আমাদের চাওয়া। আজকের এই সংবর্ধনা, আজকের এই ফলাফলে সন্তুষ্ট হয়ে থেমে যাওয়া যাবে না। ভবিষ্যতেও সত্যিকারের মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে যেতে হবে।
ট্রাস্টের সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, তোমরা জামেয়া থেকে যোগ্য আলেম হয়ে মাযহাব মিল্লাতের সেবায় মনোনিবেশ করবে। এর থেকে বেশি কিছু আমাদের চাওয়ার নেই। এশিয়ার বিখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানের শান মান এবং মর্যাদা যেনো উজ্জ্বল হয় সেদিকে তোমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে।
গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান প্রফেসর আবুল মহসিন মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বলেন, এই সফলতার পেছনে যাদের অবদান রয়েছে, অধ্যক্ষ ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকগণকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ভবিষ্যতেও এ সফলতার ধারা ধরে রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। শেষে দোয়া ও মুনাজাত পরিচালনা করেন অধ্যক্ষ কাজী আব্দুল আলীম রেজভী।
উল্লেখ্য, গত দাখিল পরীক্ষায় জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা থেকে মোট ২৭১ জন শিক্ষার্থী দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১৪৩ জন জিপিএ– এ প্লাস, ১২৫ জন জিপিএ–এ, দুইজন এ মাইনাস এবং একজন বি গ্রেড পেয়ে শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস করেছে। গতকাল জিপিএ–৫ প্রাপ্ত ১৪৩ জন শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।