মধ্যযুগে ভারতীয় সংগীতে ইসলামী প্রভাব

ইকবাল হায়দার | বৃহস্পতিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২৫ at ৭:২৯ পূর্বাহ্ণ

ভারতে মুসলমানদের আক্রমণ শুরু হয় ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে। ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজই প্রথম তা শুরু করেন। মুসলমানদের আক্রমণের সাথে সাথে ইসলামী কলার প্রভাবও ধীরে ধীরে শুরু হতে থাকে। যার সূচনা হয় দক্ষিণ ভারত থেকেই। ‘সংগীত রত্নাকর’এ বর্ণিত ‘তুরস্ক তোড়ী’, ’তুরস্কগৌড়’ প্রভৃতি রাগের নাম থেকে তার ইতিহাস ও বর্ণনা জানা যায়।

১১৭৪ সালে মোহাম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমণের পর থেকে ইসলামী কলার প্রভাব আরো স্পষ্ট ভাবে পরিলক্ষিত হতে থাকে। আশ্চর্য শাঙদেব এর সংগীত রত্নাকর এ যার উল্লেখ আছে এবং ভারতে মুসলমানদের আক্রমণের পর থেকে ধীরে ধীরে খাঁটি ভারতীয় স্বর্ণযুগের পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়।

বলতে গেলে মুহাম্মদ ঘুরির সময় থেকেই ভারতের সংগীত জগতে ইসলামী যুগের সূচনা হয়। পরবর্তীতে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সিংহাসনে আরোহণের পর থেকেই ভারতীয় প্রাচীনতম সংগীতের উৎকর্ষতা শুরু হয়(১২৮৫১৩১৬)

সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী যদিও নিরক্ষর ছিলেন তবুও তিনি বিদ্যোৎসাহী ও শিক্ষানুরাগী ছিলেন। সংগীতের প্রতি তার যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। জানা যায় তার দরবারে সুপ্রসিদ্ধ কবি ও সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আমির খসরু প্রতি রাতে নাকি তাকে একটি করে নতুন গজল শোনাতেন। দিল্লীর তুর্কী সুলতানদের মধ্যে আলাউদ্দিন খিলজিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ ।

কথিত আছে তাঁর সেনাপতি মালীক কাফুর যখন দাক্ষিণাত্য জয় করে দিল্লিতে ফিরে আসেন, সেই সময় তিনি সংগীত প্রিয় সম্রাটের জন্য সেখানকার কয়েকজন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞকেও সংগে নিয়ে আসেন। দেবগিরি রাজের দরবার গায়ক প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ গোপাল নায়ক ছিলেন তাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রত্ন। সেই গোপাল নায়কের সাথে আমীর খসরুর প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে খসরুর কাছে নায়ক পরাস্ত হলেও আমির খসরুর অগাধ পাণ্ডিত্য ও গুণগ্রাহীতার কারণে পরাজিত গোপাল নায়ককে খসরু বিশেষ সম্মানের সঙ্গেই দরবারে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আমীর খসরুর জন্ম ভারতের মাটিতে হলেও তাঁর পিতা খোরাসান থেকে ভারতে এসেছিলেন।

আমীর খসরু ছিলেন যেমন বুদ্ধিমান তেমনি সুচতুর। যেমন ছিলেন গায়ক, তেমনি কবিতা রচনাতেও ছিলেন যথেষ্ট দক্ষ। ফরাসী সাহিত্যেও এঁর অবদানের স্বীকৃতি আছে। ইনিই প্রথম ভারতীয় সংগীতের সংগে পারস্য দেশের সংগীতের সংমিশ্রণ ঘটান। ফলস্বরূপ ভারতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে নতুন রীতির, নতুন নতুন রাগিনীর আমদানি হয়। তাঁর সৃষ্ট রাগিনীদের মধ্যে ফিরদোস্ত, সাজগিরি, সরপরদা, ইমন, জীলফ, মুনম, নিগার, সাহানা উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় সংগীতে পারস্য সংগীতের অনুকরণে ‘মোকাম’ কথাটির প্রবর্তক আমীর খসরু। রাগগুলিকে তিনি ১২টি মোকামে বিভক্ত করেন।

এ ছাড়া তিনি কণ্ঠ সংগীতের আরো নতুন ধরনের চার রকম রীতির প্রবর্তন করেন যেমন:

) ফারসী ও আরবী ভাষার সংমিশ্রণে রচিত ভারতীয় ঢংয়ের গান কওল। ২)তিল্লানা বা তেলেনা। ৩)‘কওয়ালী’পারসিক ও ভারতীয় শৈলীর মিশ্রিত রূপ। ৪) খ্যাল বা খেয়াল। ইনিই প্রথম গজল ও কাওয়ালীকে পরিমার্জিত করে সংগীতের পংক্তিভুক্ত করেন। তার সময় ইয়ামিনী গায়কের দল যাদের ‘কবাল’ বলা হত তারা আরবীয় রীতির গান গাইতো। সুলতান গিয়াসউদ্দিন ও আলাউদ্দিনের প্রীতির ছায়ায় বসে আমীর খসরু এর কিছু উন্নতি করেন। আমীর খসরু প্রবন্ধ অংগের নকশ গুল , কওল, কলবানার সৃষ্টি করেন।

এ ছাড়া খসরু সাহেব কতগুলো বাদ্যযন্ত্র ও তাল তৈরি করেছিলেন । সেগুলো হল : সেতার,ঢোল,তবলা প্রভৃতি যণ্‌ত্র এবং খমসা সওয়ারি,যৎ, ফরোদস্ত, পশ্‌েতা, কাওয়ালী, আড়াচৌতাল, ঝুমরা, সুর ফাঁকতাল প্রভৃতি তাল।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে সুলতান হোসেন শর্কীর নাম পাওয়া যায়যার নাম ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে আজো অমর হয়ে আছে এবং চিরকাল থাকবে। হোসেন শাহ শর্কী জৌনপুরের স্বাধীন বাদশাহ ছিলেন।

শর্কী সংগীতে অসাধারণ পাণ্ডিত্য দেখান। তার সংগে খসরুর খেয়ালের সংগে সামান্য সামান্য বিষয়ে প্রাচীন রাসক, একতালী প্রভৃতির মিল ছিল। শর্কী খেয়ালে এদের বিশিষ্টতা যোগ করলেন। এল মধ্যগতি ও স্থায়ী বিস্তার যুক্ত খেয়াল। এ ছাড়াও শর্কী কয়েকটি নতুন রাগ সৃষ্টি করেন। জৌনপুরী, জৌনপুরী তোড়ি, সিন্ধু ভৈরবী, রসুলতোড়ী, সিন্ধুরা এবং ‘শ্যাম’ রাগের বারোটি প্রকার।

ইতিহাস থেকে জানা যায় মুসলমান শাসনামলই ভারতীয় সংগীতের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ ছিল যার বিস্তৃতি ছিল ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ পর্যন্ত। আরো জানা যায় মুঘল যুগের বাদশাহি উত্তেজনা ও উৎসাহ যোগে ভারতে সংগীতের অনেক উন্নতি ও সমধিক শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে।

১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন আকবরের রাজ্যাভিষেক হয় তখন তাঁর বয়স ছিল তেরো বছর। প্রায় অর্ধশতাধিক কাল রাজত্ব করার পর ১৭ অক্টোবর, ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে তেষট্টি বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তার সময় ভারতীয় সংগীতের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছে। আকবর নিরক্ষর ছিলেন বটে কিন্তু তাঁর জ্ঞান পিপাসা ছিল অসাধারণ। সাহিত্য, সংগীত, ইতিহাস, চিত্রকলা, ধর্মতত্ব, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তিনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। সংগীতের প্রতি যে তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল আবুল ফজল রচিত ‘আইনআকবরী’ গ্রন্থে এর বহু প্রমাণ বিদ্যমান আছে।

বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী তানসেন ছিলেন মহামতি সম্রাট আকবরের প্রিয়তম সভাসদ। আকবর তাঁর দরবারে নবরত্নের সমাবেশ করেছিলেন। এখানে বিশিষ্ট স্থান ছিল তানসেনের। এ ছাড়াও হিন্দি রস সাহিত্যের বিখ্যাত কবি রাজা বীরবলও ছিলেন রত্ন রাজির অন্যতম। এই সময়েই কবি ও সাধক গোঁসাই তুলসীদাস ও সুরদাসের অভ্যুদয় হয়।

আকবরের দরবারে যে মোট ছত্রিশ জন কলাকারের উল্লেখ পাওয়া যায় তাদের মধ্যে সকলের মতে তানসেন ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। শুধু তাই নয় ‘আইনআকবরীর’ লেখক আবুল ফজলের মতে, তখন থেকে এক হাজার বছর পূর্ব পর্যন্ত তান সেন ছিলেন অদ্বিতীয় ।

আকবর শুধু সংগীতের সমঝদার ছিলেন না , তিনি যেমন সংগীতের বিজ্ঞান ভালভাবে জানতেন তেমনি খুব ভাল নাকাড়ানামক বাদ্যযন্ত্রটিও বাজাতে পারতেন। তা ছাড়া পারস্যদেশের অনেক রাগরাগিনীর সংগে ভারতীয় সংগীতের মিশ্রণ করে তিনি পনেরোটি রাগিনীর সৃষ্টি করেছিলেন।

সম্রাট আকবরের আমলেই পুন্ডরিক বিঠ্‌টল নামে আরেক সংগীত বেত্তার পরিচয় পাওয়া যায় । তিনি খন্দেশের রাজা বুরহান খাঁ ফারুকীর আশ্রয়ে সদাগ্র চন্দ্রোদয়সংগীত গ্রন্থটি রচনা করেন, রাজা মনসিংহের আজ্ঞানুসারে লেখেন ‘রাগ মঞ্জুরী’ গ্রন্থ ও সম্রাট আকবরের ইচ্ছানুসারে ‘রাগমালা’, ও ‘নৃত্য নির্ণয়’ গ্রন্থ দুটি রচনা করেন।

একই শতাব্দীতে সম্রাট শাহ জাহানের রাজত্বকালেও (১৬২৭১৬৫৮ খ্রিঃ ) সংগীতের সমধিক উৎকর্ষতা পাই। তিনি নিজে গায়ক ও গুণগ্রাহী ছিলেন। তাঁর দরবারে যে ক’জন সংগীতজ্ঞ ছিলেন তাদের মধ্যে জগন্নাথ নাম গুণীকে ‘কবিরাজ’ও লাল খাঁ কে ‘গুণ সমুদ্র’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাঁর রাজত্বকালে আমরা পাই পণ্ডিতপ্রবর অহবোলকেও। যার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সংগীত পারিজাত’ রচনা ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে। আজও সংগীতজ্ঞদের কাছে পরম আদরে সমাদৃত। অহবোলই প্রথমে বীণায় তারের দৈর্ঘ্য থেকে শুদ্ধ ও বিকৃত বারোটি স্বরের স্থান নির্ণয় করেছেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেব সম্রাট শাহজাহানের জীবিতকালে দিল্লির উপকণ্ঠে রাজ্যাভিষিক্ত হন ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে এবং আলমগীর উপাধিতে ভূষিত হন। ১৭০৭ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন। তিনি নিজে সংগীতে পারদর্শী ছিলেন কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সংগীতের প্রতি স্ববিরোধী আচরণ করেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের কঠোর বিধিনিষেধ সত্ত্বেও দক্ষিণ ভারতের সংগীতজ্ঞানী পণ্ডিত ব্যংকটমখী দীক্ষিত বিখ্যাত সংগীত গ্রন্থ ‘চতুর্দন্ডী প্রকাশিকা’ রচনা করেন যাতে তিনি কর্ণাটক সংগীতের এক সপ্তক থেকে বাহাত্তর ঠাট এবং একটি ঠাট থেকে ৪৮৪ টি রাগ উৎপন্ন হবার অংক কষে দেখিয়েছেন আর পণ্ডিত ভাবভট্ট লেখেন অনুপ সংগীত বিলাস, অনুপ সংগীত রত্নাকর, অনুপ সংগীতাংকুশ ও ‘মুরলী প্রকাশ’।

আওরঙ্গজেবের পরে ১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দে রোশন আখতার ‘মুহম্মদ শাহ’্‌ উপাধিতে সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৭৪৮ খ্রীঃ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন। তিনি অত্যন্ত বিলাসী ও সংগীত প্রেমী ছিলেন। তারই দরবারে ছিলে বিখ্যাত বীণাকার নেয়ামত খাঁ যিনি ‘সদারংগ’ নামে বিশেষ প্রসিদ্ধিলাভ করেছেন। সদারংগ অনেক খেয়াল রচনা করেন।

ঐ সময়ে টপ্পা গানের বিশেষজ্ঞ ও বিখ্যাত প্রচারক শোরী মিয়া যার আসল নাম গুলাম নবী শোরীর অভ্যুদয় হয়। তিনি প্রথম টপ্পা গানকে ভদ্রপোষাক পরিয়ে ভদ্র সমাজে প্রচার করেন। ইতিহাসে দেখা যায়, মুসলমানী আমলে ভারতীয় সংগীতের প্রচুর উৎকর্ষতা অব্যাহত ছিল এবং সম্রাট আকবরের আমলে হয়েছিল তার চরম বিকাশ। ভারতীয় সংগীত প্রাচীনতম হলেও তার গায়ে নতুনত্বের ছোপ ও নবরূপে সম্বৃদ্ধি ও প্রাণ পেয়েছিল মুঘল আমলেই। নতুন রঙে রঙিন হয়ে উঠল ভারতীয় সংগীতের ভুবন সেই সময়ে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, লোক গবেষক, সংগীতশিল্পী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংকোচ ছেড়ে আত্মবিশ্বাসের পথে এগিয়ে যেতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধকমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী : পরার্থপরতার রাজনীতি ও আজকের বাংলাদেশ