ছোটবেলা থেকে আমাদের পান্তাভাত খাওয়ার অভ্যাস ছিল (গ্রামাঞ্চলে পানিভাত হিসাবে বেশি পরিচিত)। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে গ্রামের বাড়িতে নাস্তার পরিবর্তে পান্তাভাত খাওয়ার প্রচলন ছিল আমাদের। রাত্রে ভাত রান্নার করার পরে খাওয়া দাওয়া সেরে যে ভাতগুলো রয়ে যেতো, ঐ ভাতে আমার মা পানি দিয়ে রাখত। পান্তা ভাত মূলত ভাত সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি। ভাত বেশিক্ষণ রেখে দিলে তা পচে খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কিন্তু পানি দিয়ে রাখলে গাজনকারি ব্যাক্টেরিয়া সেখানে ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে যার ফলে পান্তা ভাতের অম্লত্ব বেড়ে যায়। তখন পচনকারি ও অন্যান্য ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ভাত নষ্ট করতে পারে না।
৮–১০ঘণ্টা পরে পান্তা ভাত তৈরী হয়। কোন প্রকার সংক্রমণ এড়াতে ভাতের ডেকসিটি ঢাকনা দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে রাখতে হবে। সকাল বেলা পান্তাভাত লবণ, কাঁচা মরিচ/পোড়া শুকনো মরিচ, পেয়াজ, আলুভর্তা, চিংড়ি মাছ, ঢেড়স ভাজি ও মাছের ঝোল দিয়ে খাওয়া হয়।
পান্তাভাত খেলে আমাদের শরীর হালকা হয়ে পড়ে ও কাজকর্ম করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান পাওয়া যায়, কারণ পান্তাভাত এক প্রকারের ফারমেন্টেড বা গাজানো খাবার যা আমাদের শরীরের পক্ষে প্রচণ্ড উপকারী, কারণ পান্তাভাতের মধ্যে প্রচুর ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয় তবে তা আমাদের শরীরে উপকারী ভূমিকা গ্রহণ করে অর্থাৎ পেটের ব্যথা কমিয়ে দেয়, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়, শরীরে তাপের ভারসাম্য বজায় রাখে। পান্তাভাতে রয়েছে পর্যাপ্ত মিনারেল, যা শরীরকে ছন্দময় করে রাখে। পান্তা ভাতের প্রো–বায়োটিক্স, ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। সাধারণ ভাতের চেয়ে পান্তাভাতে ২১গুণ বেশি আয়রন থাকে, যা রক্তস্বল্পতা বা এনিমিয়া প্রতিরোধ ও নিরাময়ে সাহায্য করে। পান্তা ভাতে রয়েছে, পর্যাপ্ত উপকারী ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত দই–এ পাওয়া যায়। ১০০গ্রাম সাধারণ ভাতে ক্যালসিয়াম থাকে ২১ মিলিগ্রাম, কিন্তু ১০০গ্রাম পান্তাভাতে ক্যালসিয়াম থাকে ৮৫০মিলিগ্রাম, যা সাধারণ ভাত থেকে ৪০গুণ বেশি। ১০০গ্রাম সাধারণ ভাতে আয়রণ থাকে ৩.৫মিলিগ্রাম, কিন্তু ১০০গ্রাম পান্তা ভাতে আয়রণ থাকে ৭৩.৯ মিলিগ্রাম, যা সাধারণ ভাত থেকে ২১গুণ বেশি। সাধারণ ভাতে সোডিয়াম থাকে ৪৭৫মিলিগ্রাম, পান্তাভাতে সোডিয়াম থাকে ৩০৩ মিলিগ্রাম। সাধারণ ভাতে পটাশিয়াম থাকে ৪০২মিলিগ্রাম, পান্তাভাতে পটাশিয়াম থাকে ৮৩৯মিলিগ্রাম।
পহেলা বৈশাখের দিন পান্তা ইলিশ খাওয়া অভিজাত পরিবারগুলোর মধ্যে বর্তমানে প্রচলন হয়ে গেছে। তাই পান্তা ভাতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে কথা হতেই পারে– তবে পান্তাভাত এদেশের প্রকৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ সময় পরীক্ষিত একটা খাবার। এটা সারাবছরই খাওয়ার উপযোগী। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন কর্মীরা পান্তাভাতের সাথে ইলিশ যোগ করে নববর্ষকে একেবারে অভিজাত হোটেলে নিয়ে গেছে।
আমাদের গ্রামাঞ্চলে সকালবেলা কৃষকেরা লাঙ্গল, জোয়াল, ও হালের গরচ নিয়ে বিলে চাষ করতে যায়। তাদের জন্য বাড়ি থেকে পান্তাভাত নিয়ে বিলে যাওয়ার প্রচলন এখনো আছে। পরিশেষে পান্তাভাত যে, কত গণ–সম্পৃক্ত খাবার বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে তার প্রমাণ আছে। গ্রামে এখানো সকাল বেলা পান্তাভাত খাওয়ার প্রচলন থাকলেও, শহরের লোকদের পান্তাভাত খাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। শহরের লোকদের সকালের নাস্তা বেশির ভাগ পরটা ভাজি ও ডিম।