প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার দিন আসলেই শিল্পী রফিকুন নবী(রনবী)-র একটা কার্টুন আমার করোটিতে হানা দেয়। যথাসম্ভব কার্টুনটি বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল। একজন মধ্যবিত্ত বাজারে যাচ্ছেন ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে, বাজার থেকে ফিরছেন পকেট ভর্তি বাজার নিয়ে। হাতে খালি ব্যাগ। পাঞ্জাবির পকেট থেকে মুলাশাকগুলো মাথা বের করে হেঁয়ালি করছে। বাজেট প্রসঙ্গে বহুবছর আগের কার্টুনটি আজও প্রাসঙ্গিক।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম. মোস্তফা কামাল, এমপি জাতীয় সংসদে গত ৩ জুন ৫০তম বাজেট উপস্থাপন করেছেন। সরকার এ বাজেটকে ‘জীবন ও জীবিকার আখ্যান’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। সেতুমন্ত্রী এর সঙ্গে উন্নয়নকে যুক্ত করে ‘জীবন ও জীবিকার আখ্যান’কে আরও শক্ত ভীতের উপর দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এ বাজেটকে কি জীবন ও জীবিকার বাজেট হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়? এই হাজার কোটি টাকার বাজেটে কেমন করে একজন ছাপোষা মধ্যবিত্তের জীবন ও জীবিকার সংমিশ্রণ হলো তা স্পষ্ট নয়। যদিওবা হয়ে থাকে, তাতে কিন্তু ধ্বংসোন্মুখ মধ্যবিত্তকে বাঁচিয়ে তোলার কোনো নির্দেশনা নেই। এই বাজেট যে জীবনের কথা বলছে, তাতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্থান নেই। যে মধ্যবিত্ত কৃষক পিতার পাঠানো টাকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পেয়ে গুলশান, বনানীতে ফ্ল্যাট কিংবা কানাডার বেগম পাড়ায় বাড়ি করতে পারেন, আমি সে মধ্যবিত্তের কথা বলছি না। যে মধ্যবিত্ত ছাত্র জীবনে ফার্স্ট বেঞ্চের মেধাধী ছাত্র হলেও মামা, খালু না থাকাতে জীবনযুদ্ধে ব্যাক বেঞ্চার হয়েছে, আমি সেসব মধ্যবিত্তের কথা বলছি। এই মধ্যবিত্তের মেরুদণ্ড অনেক শক্ত, এরা ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। এবারের বাজেটে এদের খুশি হওয়ার মতো কোনো নির্দেশনা নেই। এবার কেন? অতীতের কয়টি বাজেটে ছিল?
বাংলাদেশের মানুষ জনাব আ.হ.ম. মোস্তফা কামালের আগে আরও ১০ জন অর্থমন্ত্রী দেখেছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নতুন মন্ত্রিসভায় তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সে বিবেচনায় তাজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন দেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী। তিনি ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর ড. আজিজুর রহমান অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপর প্রধান সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান, ড. এম এন হুদা, এম সাইফুর রহমান, এএমএ মুহিত, এম সায়েদুজ্জামান, মেজর জেনারেল (অব.) মুনিম, ড. ওয়াহিদুল হক, এসএএমএস কিবরিয়া, মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ এবং এসএএমএস কিবরিয়া ব্যতিত আর কেউ মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন মান উন্নয়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। অতীতের বাজেটসমূহ পর্যালোচনা করলে এ কথার সত্যতা মিলবে। এবারের বাজেটও এর ব্যতিক্রম না।
মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের নিরাপদ ভরসাস্থল ‘জাতীয় সঞ্চয়পত্র’ নিয়ে নানান ধরনের করারোপ বাজেট যে মধ্যবিত্তের বিড়ম্বনা, তারই সাক্ষ্যবহন করে। সুদের পরিমাণ কমিয়ে ক্ষান্ত হননি, এর উপর আবার করারোপ করা হয়েছে। এবার বলা হচ্ছে, দুই লক্ষ টাকার উপরে সঞ্চয়পত্র কিনলে টিন নম্বর লাগবে। এটা আরেক ধরনের বিড়ম্বনা। এছাড়াও সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রের আছে আরও প্রতিবন্ধকতা। যেমন এক নামে ৩০ লক্ষ টাকার বেশি কেনা যাবে না, ৫০ লক্ষ টাকার কেনা যাবে না ইত্যাদি। ্এসবের মাধ্যমে মূলত সঞ্চয়পত্র না কিনতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রতিবারই দেখি সঞ্চয়পত্রে হাত বসানো হয়। আবার এখান থেকেই ঋণ নেন। এবারের বাজেটেও আছে, সরকার ‘জাতীয় সঞ্চয়পত্র’ থেকে ঋণ গ্রহণ করবেন ৩২ হাজার কোটি টাকা।
শিক্ষা খাতের সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা যোগসূত্র আছে। এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের মাত্র ১১.৯২%। জাতীয় আয়ের (জিডিপি) হিসেবে ২.০৮%। শিক্ষা খাতের ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা, যা এ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের ৩৬.৫৭%। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা, যা শিক্ষা বাজেটের ৫০.৭১%। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা, যা শিক্ষা বাজেটের ১২.৭২%। এখানেও নাকি শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেটে শিক্ষা খাতের আকার বড় দেখাতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বাজেটকে শিক্ষা খাতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৭ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, যাকিনা এডিপির ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। কিন্তু কোভিড-১৯ মোকাবিলায় টিকাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল থাকছে, যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বরাদ্দের অতিরিক্ত। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে বরাদ্দ দেওয়া রয়েছে, নতুন বছরের বরাদ্দ তার তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশে চিকিৎসাখাতে মাথাপিছু খরচ হয় পৃথিবীর অনেক দেশের চাইতে কম। চিকিৎসাখাতে রাষ্ট্রের চাইতে ব্যক্তিকেই বেশি ব্যয় করতে হয়। তাই এদেশে মানুষের অসুখ হলে ডাক্তার সাহেবরা আগে রোগীর পকেটের খবর নেন।
মধ্যবিত্তের বাজেটের কথা বলতে গিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের দিকে দৃষ্টি প্রদানের কারণ বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিই দেশীয় শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের প্রধান গ্রাহক। যদিও স্বপ্ন দেখে বিদেশে পড়ার কিন্তু অর্থাভাবে বাইরে যেতে পারে না। একই কথা স্বাস্থ্যের জন্যও প্রযোজ্য। তাদের স্বাদ থাকে কিন্তু সাধ্য থাকে না।
বাংলাদেশে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করে সাধারণত মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানেরা। আমি টিকটক সংস্কৃতির কথা বলছি না। আমি বলছি, বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার কথা। কিন্তু এখাতে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে দশমিক ৮ শতাংশ, তাহলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কি কাজ করবে? এবছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। এ বছর এ খাতে আরও বেশি বরাদ্দ দরকার ছিল। আমাদের তরুণ সমাজকে বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করতে বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। উগ্রবাদিতা, ধর্মান্ধতা থেকে রক্ষা পেতে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার বিকল্প নেই। এসব কথা আমরা সবাই জানি, নীতি-নির্ধারকদের মুখে হর-হামেশা শুনি। কিন্তু বাজেটে এর কোনো প্রতিফলন দেখি না।
গত ১০ বছরে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের বেতন-ভাতা বেড়েছে তিনগুণ। এবছর খাতে বরাদ্দ ১৭ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, এডিপির ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বাজেটের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ভাতার জন্য। এবারের বাজেটেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ বাড়ছে। যা গত বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। তাহলে, কার প্রয়োজনে এই বাজেট? উত্তর এ বাজেট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য। আগেই বলেছি, ব্যবসায়ী বান্ধব বাজেট বলছেন, ব্যবসায়ী সমাজ। সব মিলিয়ে উপকারভোগীর সংখ্যা কত? উত্তর যাইহোক না কেন বাজেটকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিড়ম্বনা ছাড়া এখনও বিকল্প কিছু ভাবতে পারছে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার, নাট্যকার