মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিরসনে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের নীরবতা কেন

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ১১ অক্টোবর, ২০২৪ at ৭:২৩ পূর্বাহ্ণ

জাতিসংঘের এই বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়: ‘কাউকে পিছিয়ে না রাখি: শর্ান্তি, টেকসই উন্নয়ন এবং মানব মর্যাদার জন্য একসঙ্গে কাজ করি’। এমন মুহূর্তটি সবাই আশা করি, যখন বিশ্ব নেতারা অর্থপূর্ণভাবে একত্রিত হয়ে কাজ করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে মানবতার ডাকে এগিয়ে আসবেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্ব নেতারা যোগদান করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল, গাজা থেকে সুদান, আফগানিস্তান, বারকিনা ফাসো, হাইতি, লেবানন, মায়ানমার এবং ইউক্রেনে গণহত্যা প্রত্যক্ষ করছে বিশ্ববাসী। বিশ্বব্যাপী এই নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা সবারই পরিচিত। তারা বেসামরিকদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে নিজেদের ব্যস্ত রাখেন। উপরন্তু যারা আলোচনার মাধ্যমে শর্র্ন্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করছেন বলে দাবি করেন; তারাই আবার কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীদের অস্ত্র এবং রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে চলছেন। এটা এভাবে হতে পারে না। এসব দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ কারও নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। বিশ্বব্যাপী এ ধরনের সংকট সৃষ্টি, কয়েক দশক ধরে অগ্নিদগ্ধ করা এবং বছরের পর বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা শক্তি। বিশ্ব নেতারা এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিতে পারেন যা মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। ইসরায়েল নৃশংসভাবে গাজায় আক্রমণ করে। যার ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটে। ইসরায়েলের এ আক্রমণের পেছনে অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো। ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় বেসামরিকদের বাসস্থান, চিকিৎসা কেন্দ্র ও সাহায্য সংস্থাগুলোতে বেআইনিভাবে আক্রমণ করেছে। ফিলিস্তিনিদের অনাহারকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে যা খুবই অমানবিক। লেবাননেও তার শত্রুতার হাত বাড়িয়েছে এবং গত সপ্তাহে ইসরায়েলি হামলায় শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন। সুদানে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে লক্ষাধিক লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটার পরও যোদ্ধারা সাহায্য বিতরণে বাধা দিচ্ছে। সুদানের সংকট শুধু ক্ষমতার দুই জেনারেলের মধ্যে লড়াইয়ের ফসল নয় এটি বহিরাগত শক্তির মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা একটি সংঘাতও বটে।

ইসরায়েল ও গাজার যুদ্ধরত পক্ষগুলোর অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা, মায়ানমারের সামরিক বাহিনীতে জেট জ্বালানি সীমাবদ্ধ করা এবং পুরো দেশকে মুক্ত রাখার জন্য সুদানে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার সময় এসেছে। যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে যুদ্ধ বন্ধ করা এবং অনেক মানুষের জীবন বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার বেআইনি বিমান হামলা, আফগানিস্তানে নারী ও মেয়েদের ওপর তালেবানের পদ্ধতিগত দমন, জাতিগত রোহিঙ্গাদের ওপর মায়ানমারের সামরিক জান্তার যুদ্ধাপরাধ ও নিপীড়ন, হাইতির রাজধানীতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং গণহত্যা মোকাবিলার জন্য আরও অনেক কিছু করা যেতে পারে। বিশ্ব পরিস্থিতি এভাবে অবনতির দিকে যেতে পারে না। আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। ইউরোপসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্বাক অবস্থানে রয়েছে যারা লেবানিজদের পক্ষে এবং শর্ন্তির জন্য দাঁড়ানোর কথা। তারা মুখ্য ভূমিকা নিলে গাজা ও লেবাননে শত্রুতার অবসান ঘটত।

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলা হলে সব সময়ই মুসলিম বিশ্ব এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। এমনকি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের মুসলিম প্রধান দেশগুলো কথা বলছে। কিন্তু ফিলিস্তিনে বড় ধরনের সংকটে পুরো মুসলিম বিশ্ব শক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এছাড়া মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি কিংবা আরবলীগও ইসরায়েলের সাথে সংকটকালে ফিলিস্তিনের পক্ষে খুব জোরালো কোনো ভূমিকা নিতে পারে না। তবে এর বিপরীতে মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে ইরান ছাড়া আর কোনো দেশকেই উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে না।

বরং কোনো কোনো মুসলিম দেশের প্রতিক্রিয়া ছিলো একেবারেই নখদন্তহীন। বিশ্লেষকরা বলছেন মুসলিম বিশ্বের জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে একাট্টা হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতার কারণে সরকারগুলোর পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে বড় সীমাবদ্ধতার জায়গা হলো পশ্চিমাদের অবস্থান। তবে ইসরায়েলফিলিস্তিন সংঘাত শুরু হওয়ার পর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে সৌদি আরব। এর আগে আমেরিকার তত্ত্ববাবধানেই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছে আরব বিশ্বের আরেক প্রভাবশালী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইসরায়েলে রকেট হামলার পর হামাসকে সমর্থন জানিয়েছে কাতার, কুয়েত ও ইয়েমেন। কিন্তু হামাসের এ হামলার বিরোধীতা করেছে আরব আমিরাত ও বাহরাইন। মিশরও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালে উভয় পক্ষকে সংযত হতে বলেছে। লেবাননে ইসরায়েলের হামলায় একটি মর্মর্ান্তিক মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। মাত্র এক দিনের ব্যবধানে এই হামলায় এখন পর্যন্ত ৫৫৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে অনেক নারী এবং শিশুও আছে। হামলা থেকে বাঁচতে নিজের ঘরবাড়ি ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য পরিবার। বাস্তুচ্যুত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। একের পর এক ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা যখন প্রায় ধুলার সঙ্গে মিশে গেছে তখন হঠাৎ করেই ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে সংঘাত বিশ্বজুড়ে মনোযোগ কেড়েছে। বিশেষ করে গত সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) লেবাননের শহরগুলোতে ইসরায়েলের ব্যাপক বিমান হামলা নতুন একটি যুদ্ধের সূত্রপাত করেছে।

ফিলিস্তিনিরা প্রতিনিয়ত নির্মম নির্যাতনের শিকার হলেও বিশ্ব মুসলমানের টনক নড়ছে না। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় আমাদের ইসরায়েলের ভিসা নিয়ে আলআকসা ভ্রমণে যেতে হবে। ফিলিস্তিনের সমস্যাটা মুসলিম উম্মাহর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এই সংকট মুসলিম উম্মাহর আত্মমর্যাদার বিষয়। এই সংকট উত্তরণে মুসলিম উম্মাহর কিছু করণীয় দিক রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের প্রায় সব দেশের মধ্যেই এক ধরনের অস্থিতিশীলতা আছে এবং রাজনৈতিক সংকট কাজ করছে। পৃথিবীতে কম বেশি প্রায় ২০০ কোটি মুসলিম রয়েছে। শুধু ফিলিস্তিন নয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই মুসলিমরা মজলুম। হত্যাযজ্ঞ কিংবা নির্যাতনের শিকার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ফিলিস্তিন, লেবানন, ইরাক, ইরান, বসনিয়া, চেসনিয়া, আফগানিস্তান, সুদানসহ আরো কতকগুলো রাষ্ট্র। জানামতে বিশ্বে পুর্ণাঙ্গ মুসলিম দেশ আছে প্রায় ষাটটির মতো। আছে ওআইসি’র মতো বিশ্ব মুসলিম সংস্থা। এ বিশাল জনগোষ্ঠী তথা প্রায় অর্ধ পৃথিবীর স্বত্বাধিকারী হওয়া সত্বেও মুসলিমরা কেন নির্যাতিত হচ্ছে! সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও বাহরাইনের মতো দেশগুলো ইসরাইলকে এক ধরনের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে ওআইসি কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইস্যুতে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে ওআইসিকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মুসলিম বিশ্ব তথা ওআইসি এক্ষেত্রে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে।

সবিশেষে উল্লেখ্য যে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ফিলিস্তিন অনেক বড় ব্যাপার। জেরুজালেমের আলআকসা মসজিদ মুসলমানদের প্রথম কিবলা। আলআকসা আমাদের আবেগের জায়গা। তাই মসজিদে আলআকসাকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিন জয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ব জয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জন্য প্রতিটি মুহূর্তেই আমাদের সরব ও সচেতন থাকতে হবে। মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহর জয় সুনিশ্চিত করুন। মুসলমানরা শ্রেষ্ঠ জাতি, বীরের জাতি, বিজয়ী জাতি। একসময় বিশ্বের বড় বড় সব পরাশক্তি মুসলমানদের কাছে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায় মুসলিম উম্মাহ পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও পরাজিত। মুসলমানদের ওপর বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রের কারণে আজ এত অনৈক্য। এই মহাবিপদ থেকে রক্ষা পেতে মুসলিম উম্মাহের ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি এবং ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। লেবানন ও ফিলিস্তিনিদের চরম দুর্দশা কমাতে দরকার মুসলিম দেশগুলোর জাতীয় ঐক্য। জাতীয় স্বার্থে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ওআইসির কার্যকরী ভূমিকা এবং এখনই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘে বিশ্ব নেতারা মুখ্য ভূমিকা নিলে মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনের গাজা ও লেবাননে শত্রুতার অবসান ও মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিরসন সম্ভব। লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার ভালোবাসা, আমার বৃষ্টিপ্রীতি
পরবর্তী নিবন্ধহযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক) : আরাধ্য গন্তব্যে