শীতের রিক্ততা মুছে প্রকৃতি জুড়ে আজ যেন কিসের শিহরিত স্পর্শ, অবাক ছোঁয়া। আজ পয়লা ফাল্গুন। পাগল হাওয়ার উত্তরীয় উড়িয়ে বনফুলের পল্লবে, দখিনা বাতাসে শিহরণ জাগানোর দিন আজ। মৌমাছির ডানায় ডানায়, নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে উঠবার আভাসে আর বনতলে কোকিলের কুহুতান বলছে : ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে..।’ ঐশ্বর্যধারী ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন।
ফুল ফুটবার পুলকিত দিন বসন্ত। কবি শামসুর রাহমান তার বসন্তের মায়ায় লিখেছেন, ‘গাছের শাখায় ফুল হাওয়ার সংস্রবে/ যখন নীরবে দিব্যি সানন্দে দুলতে থাকে, পথচারী/ অথবা জানালা–ধরে–থাকা যুবতীর চোখ পড়ে/ কে জানে কী ছবি সব দোলে কিছুক্ষণ!/ বসন্তের মায়া রয়ে যায় বাস্তবিক নানাভাবে।’
নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্র সঙ্গীতে যতো আছে,/ হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে বনের কুসুমগুলি ঘিরে।/ আকাশে মেলিয়া আঁখি তবুও ফুটেছে জবা,/ দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে,/ তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্তপথিক।’
বসন্তে নৈসর্গিক প্রকৃতি বর্ণচ্ছটায় বাঙময় হয়ে ওঠে। কচি পাতায় আলোর নাচনের মতোই বাঙালি তরুণ মনে লাগে দোলা। হৃদয় হয় উচাটন। বন–বনান্তে, কাননে কাননে পারিজাতের রঙের কোলাহল আর বর্ণাঢ্য সমারোহ। ভাটিবাংলার কণ্ঠ শাহ আবদুল করিম তাই গেয়ে ওঠেন : ‘বসন্ত বাতাসে সই গো/ বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে…।’
বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি অনাদিকাল থেকেই। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই পেয়েছে নানা অনুপ্রাস, উপমা, উৎপ্রেক্ষায়। ঋতুরাজ বসন্তের আবাহন আর পশ্চিমের ভ্যালেন্টাইন ডে যেন এক বৃন্তের দুটি কুসুম। এ যেন এক সুতোয় গাথা দুই সংস্কৃতির এক দ্যোতনা। মানুষের মতোই এ সময় পাখিরাও প্রণয়ী খোঁজে, বাসা বাঁধে। রচনা করে নতুন পৃথিবী।
বসন্ত মানেই পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। কচিপাতায় আলোর নাচনের মতোই বাঙালির মনেও লাগবে দোলা। বিপুল তরঙ্গ প্রাণে আন্দোলিত হবে বাঙালি মন। বাঙালি জীবনে বসন্তের আগমন বার্তা নিয়ে আসে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র। এ বসন্তেই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল। বসন্তেই বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল। দিনটিকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবেও পালন করার প্রস্তুতি নিয়েছে একাধিক সংগঠন। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মজিদ খান কমিশনের গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান করে সচিবালয় অভিমুখী ছাত্র–জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন জয়নাল, জাফর, মোজাম্মেল, দিপালী, কাঞ্চনসহ অনেকে। বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস পালন করা হবে। তাই কেবল প্রকৃতি আর মনে নয়, বাঙালির জাতীয় ইতিহাসেও বসন্ত আসে বিশেষ মাহাত্ম্য নিয়ে। বসন্ত হয়ে উঠে এক অনন্য উৎসব।
প্রকৃতির বসন্তকে জীবনের লৌকিক ও আত্মিক আনন্দের গভীরতম স্পর্শে–অনুরাগে, রূপলোকের প্রতিমার ছোঁয়ায় শিহরিত–স্পন্দিত করার আয়োজনের নাম বসন্ত উৎসব। বাঙালি আদি ও অকৃত্রিম হৃদয় ছোঁয়ায় বরণ করতে প্রস্তুত। ঋতুরাজ বসন্তের আগমন নীরবে নিভৃতে হবার জন্য নয়, তাকে বরণ করে নিতে প্রকৃতি যেমন তার সবটুকু দিয়ে অর্ঘ্য সাজিয়েছে, তেমনি নগরবাসীও বসন্তকে বরণ করে নিতে আজ ভিড় করবে সিআরবি, শিল্পকলা, লালদীঘি কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জারুলতলায়। খোঁপায় গাঁদা ফুল গুঁজে, বাসন্তী শাড়িতে নিজেকে সাজিয়ে যে মেয়েটি একলা প্রহর গুণছিল ভালোবাসার, তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার আগেই মধুর বসন্তের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে প্রিয়তম পুরুষটি আজ বাড়িয়ে দেবে তার বিশ্বস্ততার হাত।
ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নিতে সিআরবির সাত রাস্তার মোড়ে উৎসবের আয়োজন করেছে প্রমা আবৃত্তি সংগঠন। বাংলার চিরায়ত গান, নাচ, আবৃত্তি, কথামালাসহ নানা আয়োজনে সকাল আটটা থেকে মুখর হবে উৎসব অঙ্গন। আজ বসন্তের প্রথম দিনটি ভালোবাসা দিবসও। তাই আনন্দ আয়োজনেও ভিন্নমাত্রা থাকাটাই স্বাভাবিক। আয়োজনের মিডিয়া পার্টনার দৈনিক আজাদী।
‘নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এলো প্রাণে’ এই শিরোনামে আবৃত্তি সংগঠন বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রাম প্রতি বছরের মতো এবারও ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে আয়োজন করতে যাচ্ছে বোধন বসন্ত উৎসব ১৪৩০। আজ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই আয়োজন থাকবে। শোভাযাত্রা, আবৃত্তি, সঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত, নৃত্য ও ঢোলবাদন, পিঠাপুলি দিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের উৎসব।
এবারও পাহাড়তলীর শেখ রাসেল পার্কে বোধন বসন্ত উৎসব ১৪৩০–এর আয়োজন করেছে। এতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সংগঠক, সংগীত, আবৃত্তি, নৃত্য ও কথামালা নিয়ে বসন্তের আগমনী আয়োজন মুখর করে তুলবে। বিকেল তিনটায় থাকছে বসন্তবরণ শোভাযাত্রা। এছাড়া সড়ক জুড়ে থাকবে আলপনা উৎসব। পুরো আয়োজনের প্রিন্ট মিডিয়া পার্টনার দৈনিক আজাদী।