মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭–১৮৫৮)। কবি, সমাজসংস্কারক। ভারতীয় উপমহাদেশের ঊনবিংশ শতাব্দীয় অন্যতম পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলার নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত হিসিবেও পরিগণিত। বাল্যশিক্ষার জন্য একাধিক পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। তিনি ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বিল্বগ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক উপাধি ‘চট্টোপাধ্যায়’ হলেও প্রাপ্ত উপাধি ‘তর্কালঙ্কার’ হিসেবেই তিনি সুপরিচিত। নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। তিনি পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ও প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের নিকট সাহিত্য, ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, জ্যোতিষ ও স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু ল’ কমিটি থেকে জজ–পণ্ডিতের সার্টিফিকেট লাভ করেন। মদনমোহন শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করে একে একে হিন্দু কলেজ পাঠশালা (১৮৪২), ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ (১৮৪৩–৪৫), কৃষ্ণনগর কলেজ (১৮৪৬) ও সংস্কৃত কলেজে (১৮৪৬–৫০) অধ্যাপনা করেন। শেষজীবনে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (১৮৫৫) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় সহযোগিতা দান করেন। ওই সময় ভারতে মেয়েদের প্রকাশ্যে শিক্ষার সুযোগ ছিল না; সমাজ তা ভাল চোখে দেখতও না। মদনমোহন মুর্শিদাবাদ ও কান্দিতে বালিকা বিদ্যালয়, ইংরেজি বিদ্যালয়, অনাথ আশ্রম, দাতব্য চিকিৎসালয় ইত্যাদি জনহিতকর প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। স্ত্রী শিক্ষার সমর্থনে তিনি সর্বশুভকরী পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় (১৮৫০) দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। রসতরঙ্গিণী (১৮৩৪) ও বাসবদত্তা (১৮৩৬) মদনমোহনের মৌলিক কাব্যগ্রন্থ। তিন খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর শিশু শিক্ষা (১৮৪৯ ও ১৮৫৩) শিশুদের উপযোগী একটি অনন্যসাধারণ গ্রন্থ; ‘পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল’ শিশুপাঠ্য এই বিখ্যাত কবিতাটি তাঁরই রচনা। মদনমোহন সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেশ কয়েকখানি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। সেগুলির মধ্যে সংবাদতত্ত্বকৌমুদী, চিন্তামণিদীধিতি, বেদান্তপরিভাষা, কাদম্বরী, কুমারসম্ভব ও মেঘদূত প্রধান।
কবি–প্রতিভার জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে তিনি ‘কাব্যরত্নাকর’ এবং পাণ্ডিত্যের জন্য ‘তর্কালঙ্কার’ উপাধি লাভ করেন। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ই মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।