মতামত : পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৫ জুন, ২০২২ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার অনন্য মাইলফলক পদ্মা সেতু। এই সেতু শুধু বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা নয়, সারা দেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা নিয়ে দৈনিক আজাদীকে বলেছেন শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।

ড. অনুপম সেন
পদ্মা সেতু গৌরবের বিজয় কেতন
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন বলেছেন, বাঙালির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা অর্জন। যার চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়ে। এই বিজয় অর্জনে বাঙালিকে বিরাট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। ৩০ লক্ষ শহীদ, ২ লক্ষ জননী-জায়ার আত্ম সম্ভ্রমের বিসর্জন দিতে হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যখন উন্নতির সোপানে তুলে আনছিলেন-ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তানপন্থী দেশদ্রোহীদের হাতে তিনি সপরিবারে নিহত হন এবং তাঁর চার সহযোদ্ধা কারাগারের অভ্যন্তরে নির্মম ভাবে হত্যার শিকার হন। বিশ্ব ইতিহাসে এমন নিষ্ঠুর ঘটনা বিরল। তারপর দীর্ঘ ২১ বছর বাঙালির পরাজয়ের ইতিহাস, পিছিয়ে পড়ার ইতিহাস, ভিক্ষাবৃত্তির ইতিহাস।

দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসিন হন- জাতির জনকের কন্যা দেশরত্ম শেখ হাসিনা। সেই থেকে আবার শুরু হয় এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস।
বিশেষভাবে ২০০৯ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর দেশে যে অভিনব বিস্ময়কর উন্নয়নের অভিযাত্রা শুরু করেন, তা বিশ্বে উন্নয়নে এক বিস্ময় হিসাবে বাংলাদেশ আজ সমাদৃত।

এই উন্নয়নের মহাবিস্ময়কর প্রতীক হিসেবে আজ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হচ্ছে। যা কেউ ভাবতে পারেনি। যখন বাংলাদেশে অনেক প্রতিথযশা অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ-বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ব্যতিরেকে পদ্মা সেতু নির্মাণ অসম্ভব এবং দেশের জন্য মহাক্ষতিকর পদক্ষেপ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা-রবীন্দ্রনাথের সেই অসাধারণ পংক্তি একলা চলোরে এই বাণীটাকেই যেন বুকে ধারণ করে একলা এগিয়ে গেলেন। তিনি পার্লামেন্টে ঘোষণা করলেন-বিশ্বব্যাংকের আনুকূল্যের প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের নিজ অর্থেই পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। সেই সময় অনেকেই তার এই ঘোষণাকে ব্যঙ্গ করেছেন।

বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নিয়ে এক অলিক অভিযোগ তুলেছিল। যা তিনি ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সেদিন বিশ্বও ভাবতে পারেনি, আমাজান নদীর পরে বিশ্বের সবচেয়ে খরস্রোতা নদী-তার প্রায় দীর্ঘ ৬ কিলোমিটারের বেশি প্রশস্ত পদ্মার উপরে বাংলাদেশ নিজ অর্থ এবং নিজ শক্তির উপর নির্ভর করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবে। আজ সেই পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। আজ তার উদ্বোধন হচ্ছে- বিশ্বকে বিস্মিত করে। বিশ্ববাসীকে তীব্র কৌতূহলে উজ্জীবিত করে। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে পদ্মা সেতু এক পরম গৌরবের বিজয় কেতন হিসেবে উজ্জীবিত হলো।

ড. মোহাম্মদ আবুল হোসাইন
২১ জেলার ১৩৩ উপজেলার মানুষের দারিদ্র্যের হার কমবে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল হোসাইন বলেন, পদ্মা সেতু একটি মাল্টিপারপাস সেতু। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ধরনের সেতু নির্মিত হলেও আমাদের জন্য পদ্মা সেতু হলো একটি স্বপ্ন এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের উদাহরণ স্বরূপ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আজকে তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদেরকে রূপকল্প-২০২১, ২০৪১ এবং ২১০০ সালের যে ডেল্টা প্ল্যান করেছেন, আজকের পদ্মা সেতু সেই দীর্ঘমেয়াদী ও দূরদর্শী চিন্তার ফসল। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি বেড়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে একটি বড় প্রকল্প তখনই করা সম্ভব যখন একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কানিক্টিভিটির কারণে ২১ জেলার ১৩৩টি উপজেলার মানুষের দারিদ্রের হার কমবে, পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে, শিল্পায়ন হবে, কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পাবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অর্থনৈতিক দিক চিন্তা করলে পদ্মা সেতু জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে মংলা বন্দরের সক্ষমতা রয়েছে ৫০ শতাংশের মতো, এখন সেটি ১০০ শতাংশে পরিণত হবে। এছাড়া রেললাইন, গ্যাস লাইন, বিদ্যুৎ লাইনের মাধ্যমে পদ্মা পাড়ের মানুষ উন্নত জীবন পাবেন। ওইসব অঞ্চল সমৃদ্ধ হলে কেউ আর ঢাকামুখী হবে না। এ ছাড়া ঢাকার সাথে এখন দূরত্বও অনেক কমে যাবে। ফলে মানুষের সময় বাঁচবে।

মাহবুবুল আলম
২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদার প্রতীক। কারণ এই সেতু তৈরিকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন করেনি। সেই সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির উদ্যোগ নেন। তাঁর দক্ষ নেতৃত্বের কারণে আজকে আমাজনের পরে বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদীতে সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়েছে বলে আমি মনে করি। এখন আসা যাক, পদ্মা সেতু জাতীয় অর্থনীতিতে কেমন ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতুর কারণে ২১ জেলার সাথে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা জোরদার হয়েছে। এই সেতুর কারণে পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের জীবন যাত্রার মান বেড়ে যাবে। এছাড়া নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। দেশের অর্থনীতিতে অন্তত ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে। এছাড়া পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে কুয়াকাটা পর্যটন এলাকা আরো সমৃদ্ধ হবে। নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, মংলা বন্দর ও পায়রা বন্দর আরো বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের এখন যে অবস্থা শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভর করলে আসলে হবে না। আমি মনে করি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে রকম অহংকার একইভাবে পদ্মা সেতুও এখন আমাদের অহংকারের প্রতীক।

এএম মাহাবুব চৌধুরী
দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসবে
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহ-সভাপতি এএম মাহাবুব চৌধুরী বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু চালু হলে লঞ্চ ও ফেরিতে যে পরিমাণ জ্বালানি তেলের ব্যবহার সেটি সাশ্রয় হবে। এরচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে মানুষের কর্মঘণ্টা বেঁচে যাবে। কারণ লঞ্চে ও ফেরিঘাটে যাত্রীদের প্রচুর সময়ক্ষেপণ হয়। এছাড়া শীতে কুয়াশার কারণে এবং বৈরি আবহাওয়ায় লঞ্চ ও ফেরি দুর্ঘটনাও ঘটে। এতে প্রচুর মানুষের প্রাণহানি হতো। এখন অন্তত সেটি আর হবে না। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যেসব পণ্য দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা শরীয়তপুর, মাদারিপুর, ফরিদপুর এবং গোপালগঞ্জে যেতো, সেগুলো এখন দ্রুত পরিবহন হবে। এতে ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা সমৃদ্ধি হবে। আবার ওইসব অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি বিদেশে রপ্তানি হয়। আগে যেখানে তিনদিন লাগতো, সেটি এখন দিনে দিনে ঢাকা বিমানবন্দরে চলে যাবে। এতে ব্যবসায়ীরাও উপকৃত হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেখ হাসিনার পদ্মা সেতু আস্থার অক্ষয় জ্যোতি
পরবর্তী নিবন্ধআঞ্চলিক যোগাযোগে বাংলাদেশের নেতৃত্বের আরেকটি দৃষ্টান্ত পদ্মা সেতু : যুক্তরাষ্ট্র