মতাদর্শে অবিচল অনন্য সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম | বৃহস্পতিবার , ২৪ জুন, ২০২১ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

যে ক’জন মানুষের সাহচর্যে এসে আমি ঋদ্ধ হয়েছি, জীবনের গভীরতাকে উপলব্ধি করতে শিখেছি, সমাজ নিয়ে প্রচলিত চিন্তার বাইরে এসে ভাবতে শিখেছি, তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম অগ্রগণ্য। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে তাঁর ছাত্রত্ব বরণ করেছি, পরে তাঁর সহকর্মী হয়েছি, কিন্তু তাঁর থেকে শেখা, পাঠ নেয়া আমার কখনো ফুরোয়নি। এখনও তিনি আমার শিক্ষক, পথপ্রদর্শক। তিনি আমার, এবং আমার সকল সহপাঠীর, প্রিয় স্যার।
স্যারের বই পড়তেন আমার বাবা; স্যারের প্রাগ্রসর চিন্তা, সমাজ নিয়ে তাঁর বলিষ্ঠ চিন্তার তিনি প্রশংসা করতেন। স্যারের নতুন কোনো বই বেরুলে বাবার জন্য সংগ্রহ করতে হতো। বাবা নিজেও শেষ জীবনে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বলতেন, তোমার স্যার আদর্শের সাথে কর্মের, চিন্তার সঙ্গে সক্রিয়তার একটা সংযোগ তৈরি করেন। এটি অনুসরণ কর। অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু অনেক দূর থেকেই। তাঁর ধারে কাছে পৌঁছানো যাবে না, কিন্তু দৃষ্টিতে তিনি থাকলে পথ চলাটা অনুপ্রেরণাদায়ক হয়। সেই অনুপ্রেরণাতে কমতি নেই, অর্জনের ঘরে শূন্য হলেও।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, কয়েকটি চিন্তা ও দর্শন তরুণদের আলোড়িত করত। এর একটি ছিল মার্কসীয় দর্শন ও বীক্ষণ, আরেকটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, তৃতীয় আরেকটি ছিল সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যচিন্তা। মার্কস-এর রাজনৈতিক দর্শন শেখানোর জন্য রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন, যাদের অনেকেই ছিলেন প্রবলভাবে নিষ্ঠাবান। ষাটের দশকে মার্কস-এর দর্শন নিয়ে কথাবার্তা হতো, আলোচনা হতো, প্র্যাঙিস-এর বিষয়টিও তখন শুরু হয়। এসবে মাঝে মধ্যে অংশ নিতাম। কিন্তু মার্কস তো শুধু রাজনীতির কথা বলেননি, বলেছেন অর্থনীতি, সমাজ, দর্শন থেকে নিয়ে সাহিত্য পর্যন্ত। মার্কস-এর বই স্টেডিয়ামের বইয়ের দোকান থেকে কিনে পড়তাম, আট আনা এক টাকা দামে। যতটুকু বুঝতাম, তার থেকে বেশি থাকত না বুঝার অঞ্চলে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মনে জাগত, এবং তা ছিল, বাংলাদেশের সমাজ, ইতিহাস ও রাজনীতির বাস্তবতায় মার্কসবাদের রূপ এবং ভূমিকা ঠিক হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের উত্তর আমি এবং আমার বন্ধুরা, মার্কস নিয়ে রাজনীতির আলোচনায় পাইনি, পেয়েছিলাম স্যারের লেখালেখিতে। গভীর জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি এবং ইতিহাস চেতনা ধারণ করত স্যারের প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো। তাঁর লেখার একটি গুণ হলো এক বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে যে কোনো চিন্তাভাবনাকে স্থাপন করা। ফলে কোনো ভাবনাই খণ্ডিত রূপে ধরা পড়ে না। পড়ে এক সামূহিকতায় বলতে দ্বিধা নেই, মার্কসবাদের যে পাঠটা আমি তাঁর লেখালেখি থেকে নিয়েছি, তা আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। এখনও মার্কসবাদ নিয়ে আমার যেটুকু উৎসাহ, তা স্যারের চিন্তাকে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি বলে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অনেক লিখেছেন। তিনি এজন্য মধ্যযুগ থেকে আঠারো-ঊনিশ শতক হয়ে কুড়ি শতকের বাঙালিয়ানা, বাংলার সমাজ ও বাঙালির চিন্তার ঐতিহ্যকে গভীর অভিনিবেশ নিয়ে পড়েছেন। এই ক্ষেত্রে তিনি অনেকের থেকে এগিয়ে, একটি সামূহিক চিন্তাকে ধারণ করেছেন। পশ্চিম বঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে যে লেখালেখি হয়েছে, তাতে হিন্দু-মুসলমান, নিম্নবর্গীয় ও প্রান্তজন, কৃষক ও শ্রমিকসমগ্রের পুরো জায়গাটা নেই। বাংলাদেশের যারা লিখছেন, তাদের অনেকেও এই সমগ্রকে মূল্যায়ন করেননি, স্যার করেছেন।
১৯৭১ সাল শুরু হতে স্যারের লেখালেখি পড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে আমাদের ভালো একটা ধারণা হয়েছিল। এর আলোকে একাত্তর ও একাত্তর পরবর্তী ইতিহাস ও সমাজকে পড়া আমাদের জন্য সহজ হয়েছিল। এখনও জাতীয়তাবাদ নিয়ে স্যারের লেখালেখি নতুন নতুন চিন্তার জন্ম দিচ্ছে। এর একটি কারণ, জাতীয়তাবাদ যেকোনো সময়েই একটি অসমাপ্ত প্রকল্প। এটি ক্রমবিবর্তনশীল, উত্তরণশীল না হলেও। সম্প্রতি তাঁর এক বৃহৎ কলেবরের বই বেরিয়েছে, যা ২০১৫ সালের প্রথম আলো-র বর্ষসেরা মননশীল বইয়ের পুরস্কার পেয়েছে, যে বইতে তিনি জাতীয়তাবাদ নিয়ে ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতির বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে লিখেছেন। সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য নিয়েও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যা লিখেছেন, তা সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের আলোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয়টা আসলে কি, কী উপাদানে এটি গড়ে উঠেছে, কাদের শ্রমেঘামে শক্তি অর্জন করেছে, কী প্রতিকূলতা একে জড় করতে হয়েছে, এসব প্রশ্নের উত্তর স্যারের লেখালেখিতে পাই। ১৯৫০-৬০-এর অস্থির সময়ে বাঙালি তার নিজস্বতার ভূমিতে একটার পর একটা পতাকা উড়িয়েছে, এবং আমরা বুঝতে চেষ্টা করেছি এসব পতাকা যারা তৈরি করেছেন, বহন করেছেন, তারা কারা, কোনো উৎস থেকে এদের উৎসার। স্যারের লেখা আমাদের দেখার দৃষ্টিটাকে, বুঝার ক্ষমতাকে অনেকটাই প্রসারিত করেছে। স্যার উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে প্রচুর লিখেছেন, গবেষণা করেছেন। তিনি এ দুই বিষয়ের ভেতরে ঢুকে পশ্চিমের সামষ্টিক মনস্তত্ত্বের আলোকে এদের নানা প্রকাশকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন। উপনিবেশবাদের সঙ্গে প্রাচ্যবাদের একটা যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, স্যারের লেখায় বহু আগেই তা আমরা দেখেছি। স্যার তাঁর চিন্তাকে শুধু বইপত্রেই মেলে ধরেননি, জীবনের নানা ক্ষেত্রেও সক্রিয় হতে দিয়েছেন। পরিবেশ নিয়ে স্যারের সক্রিয়তা আমরা দেখেছি। এখন যাকে পরিবেশ-তর্ক বা ইকো-ক্রিটিসিজম বলা হয়, তা অনেক আগেই স্যারের লেখায় দেখেছি। নারীবাদ নিয়ে তিনি মৌলিক চিন্তা করেছেন, সাহিত্যের নারীদের নিয়ে লিখতে গিয়ে নারীবাদের যেসব সূত্র তিনি তুলে ধরেছেন, সেগুলো আমাদের সময়ের নারীবাদ বা ভাবনার জন্যও মূল্যবান হতে পারে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সারা জীবনের সাধনা জ্ঞানকে সামাজিক সক্রিয়তার কেন্দ্রে নিয়ে আসা। তিনি নিরন্তর মানুষের শ্রেয়বোধ, শুভচিন্তা এবং সংগ্রামী চিত্তকে জাগাবার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি এখন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেন, যার মূল দর্শন হবে সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব এবং স্বাধীনতা। তিনি শিক্ষাকে সমাজ পরিবর্তনের এক আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে দেখেন- সেই শিক্ষা, যা চিত্তকে জাগায়। যদি এই সম্ভাবনাগুলো আমরা করায়ত্ত করতে পারি, তাহলে স্যারের প্রতি আমরা প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখাতে পারব। স্যারের পঁচাশিতম জন্মদিন উপলক্ষে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালোবাসা। পাশাপাশি তাঁর দীর্ঘ, কর্মময় জীবন কামনা করি।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধকঠোর লকডাউনেও সচল থাকবে আকাশপথ