করোনাভাইরাস মহামারীতে স্থবির চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। মঞ্চগুলোতে আলো জ্বলছে না। সুরের ঝংকার নেই, অভিনয় পারদর্শিতা প্রদর্শনের সুযোগ নেই, নূপুরের নিক্কন নেই, জাদুকরের মোহময়তা নেই, আবৃত্তির মুগ্ধতা উধাও। কোথাও নেই কোনো আয়োজন।
এ যেন এক মৃত্যুপুরীতে বসবাস। এ নিস্তব্ধতা কবে কাটবে তা বলতে পারছেন না কেউ। এ ঘোর অমানিশা কেটে আলোয় ভরে উঠুক-এ প্রত্যাশা চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীদের। সঙ্গীতশিল্পী, মডেল, অভিনয়শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, মঞ্চশিল্পীসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সব স্তরের কর্মীরা এখনো পুরোপুরি কর্মহীন অবস্থায় ঘরবন্দি হয়ে আছেন। দীর্ঘদিন গৃহবন্দি এবং শো-বিহীন, আয়বিহীন অবস্থায় থাকা সংস্কৃতিকর্মীদের খোঁজ নেওয়ারও নেই কেউ। কেউ বাধ্য হয়ে পেশা পাল্টেছেন, কেউ দিন গুণছেন সরকার কখন অনুমতি দেবে সেই প্রত্যাশায়। অথচ করোনার সংকটকালের আগে এমন কোনো দিন ছিল না, যেদিন চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির মুক্তমঞ্চ কিংবা থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে কোনো অনুষ্ঠান হতো না। অনুষ্ঠান হতো বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে কিংবা অন্য কোনো পাবলিক প্লেসে। করোনার আগে মাসে হাতে থাকত অন্তত ২০ থেকে ২৫টি অনুষ্ঠান। সিডিউলের ব্যস্ততায় তালিকা থেকে বাদও দিতে হতো কোনো কোনোটা। করোনাকালে অনুষ্ঠান আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরপরই দুঃসময়ে কাটছে মঞ্চশিল্পীদের দিন।
চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক নাট্যজন সাইফুল আলম বাবু আজাদীকে বলেন, সবকিছু একে একে খুলে দেওয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই বন্ধ আছে। এর কারণ বোধগম্য নয়। আমরা ঢাকা শিল্পকলা একাডেমির সাথেও যোগাযোগ করেছি। তারা বলছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাথে তারা কথা বলছে। আমাদের কথা হলো, সরকার একটা নীতিমালা করে দিক, সেই নীতিমালা অনুযায়ী আমরা অনুষ্ঠান করব। আগামী মাসে এর একটা সুরাহা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি।
তিনি আরো বলেন, আমরা অনুষ্ঠান করতে চাই। প্রয়োজনে ২৫০ চেয়ারে ৫০ জন বসবে। প্রয়োজনে মুক্তমঞ্চেই অনুষ্ঠান করব। নিজের ভালোটা তো আমরা নিজেরা বুঝি। আমরা বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ উদযাপন করতে পারিনি। অনেকগুলো জাতীয় দিবস চলে গেছে। সামনে বিজয়ের মাস আসছে। তাছাড়া অনুষ্ঠান যে করব তার জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। সেটা নাটক, গান, নৃত্য যে ক্ষেত্রই হোক না কেন, ছয় মাস অনুষ্ঠান না করার পর হুট করে তো মঞ্চে উঠতে পারব না। তার জন্য অন্তত এক মাসের প্রস্তুতির প্রযোজন আছে। আমাদের মহড়া কক্ষগুলো খুলে দেওয়া হোক।
তিনি বলেন, কিছু কিছু সংগঠন অনলাইনে তাদের আয়োজন করে যাচ্ছে। কিন্তু তা কতজন দেখছে? কয়টি সংগঠন করতে পারছে? হয়তো দশ/পনেরটা সংগঠন অনলাইনে সক্রিয় আছে। কিন্তু আরো শত শত সংগঠন আছে, যারা তা করতে পারছে না। কাজেই একটা নীতিমালার আলোকে আমরা আবারও মঞ্চে উঠতে চাই।
চট্টগ্রাম মঞ্চ শিল্পী সংস্থার সভাপতি সঙ্গীতশিল্পী আলাউদ্দিন তাহের বলেন, আমরা সবাই একটা আতঙ্কের মধ্যে আছি। সাত মাস ধরে সকল অনুষ্ঠান বন্ধ। এই পরিস্থিতি কবে শেষ হবে জানা নেই। কোনো কাজ নেই, অনুষ্ঠান নেই, আয় রোজগার সবই বন্ধ। চট্টগ্রামের সব বড় বড় আয়োজনে যার কণ্ঠস্বর একরকম অপরিহার্য বলা যায়, তাঁর কণ্ঠও থেমে গেছে। কাজ নেই।
তিনি বলেন, আমরা যারা শিল্পী এবং এই পেশার ওপরই নির্ভর করি তাদের দুরবস্থা কেমন তা বলে বুঝানো যাবে না। আমাদের খোঁজ নেওয়ারও কেউ নেই। ক’দিন আগে একটি কমিউনিটি সেন্টারে চারটি সংগঠন মিলে সাংবাদিকদের সাথে একটা মতবিনিময় করব বলে সিটি এসবি থেকে অনুমতি নিতে গিয়েছিলাম। মতবিনিময় শেষে খাওয়া দাওয়া হবে আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে কিছুক্ষণ। অনুমতি পাইনি। তারা বলেছেন মতবিনিময় করলে রেস্টুরেন্টে করতে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রশ্নই উঠে না। রেস্টুরেন্টে যদি মতবিনিময় করতে পারি, তবে আরো বড় পরিসরে সে অনুষ্ঠানটি কেন করতে পারব না তা বোধগম্য নয়। অবশ্য তাদেরও দোষ দিয়ে লাভ নেই। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের কাজ করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, নীরবে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। অনেকদিন আলো ঝলমলে মঞ্চে ওঠা হয় না। চরম দুঃসময় পার করছি আমরা।