পবিত্র ভূমি মক্কায় অবস্থিত কাবা শরীফের আশেপাশে ইসলামী সংস্কৃতির স্মৃতিবাহী অনেক নিদর্শন রয়েছে। কাবা শরীফের এলাকা যেখানে শেষ– মিসফালাহ এলাকা সেখান থেকে শুরু। মিসফালাহ জায়গাটি ইসলামী ইতিহাসের বিবেচনায় অতি গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ এখান থেকেই শুরু হয়েছে হিজরা রোড। নবী করিম (সা.) হিজরতের সময় মক্কা থেকে মদিনার দিকে এই রাস্তায় হেঁটে গিয়েছিলেন। সেজন্যেই এই নামকরণ হয়েছে বলে জানা যায়।
মিসফালাহ শব্দের অর্থ নিচু জায়গা। পাহাড় ঘেরা মক্কার অপেক্ষাকৃত নিচু ভূমি এই এলাকা। মক্কা হেরেম শরিফ থেকে বামে ইব্রাহিম খলিল রোড মিসফালাহ হয়ে চলে গেছে শহরের দিকে। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) এই রাস্তা দিয়ে আল্লাহর ঘর কাবায় এসেছিলেন বলে এর নাম ইব্রাহিম খলিল রোড রাখা হয। এই এলাকায় শতাধিক ছোট বড় আবাসিক হোটেল রয়েছে। এই সব হোটেলের দুই তৃতীয়াংশ পরিচালিত হয় বাংলাদেশীদের দ্বারা। রয়েছে অনেকগুলি মসজিদ, যার অধিকাংশ ইমাম ও মুয়াজ্জিন বাংলাদেশি। মিসফালায় কিছুক্ষণ হাঁটলে চারপাশে অনেক বাংলাদেশি মানুষজনের দেখা মেলে। অনেকের হঠাৎ মনে হতে পারে বিদেশের মাটিতে এত বাংলাদেশি কোত্থেকে এলো! মসজিদুল হারামের কাছে জমজম টাওয়ারের (ক্লক টাওয়ার) পেছনের এলাকা মিসফালাহ। ছোট্ট মাঠের মতো খোলা জায়গায় দিনের বেলা প্রায় সব সময় অসংখ্য কবুতর থাকে। এটি বাঙালিদের কাছে কবুতর চত্বর বা কবুতরের মাঠ নামে পরিচিত। মিসফালাহ এলাকায় দোকানসহ রেস্টুরেন্ট আছে চার শতাধিক। এরইমধ্যে তিন চতুর্থাংশ পরিচালিত হয় বাংলাদেশিদের মাধ্যমে। বছরের বেশির ভাগ সময় হজ ও ওমরা উপলক্ষ্যে এ এলাকা বাংলাদেশিদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। রেস্টুরেন্টগুলোতে ভাত, মাছ, গরুর গোশত, উটের গোশত, সবজি, রুটি, মিষ্টি –সবই পাওয়া যায়। রেস্টুরেন্টের পরিবেশ যাই হোক না কেন, খাবার নিয়ে কোনোরকম ঝামেলায় পড়তে হয় না হাজীদের। এ ছাড়া অনেক সময় হাজিদের সম্মানে মিসফালায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে খাবার বিতরণ করা হয়। মিসফালায় বাংলাদেশীরা রেস্টুরেন্ট ছাড়াও কসমেটিকস, জুয়েলারি, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিঙ দ্রব্য, রেডিমেড কাপড়ের দোকান, জুস্যের দোকান, মুদির দোকান, সবজির দোকান, স্টেশনারি, গিফ্ট শপসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন। প্রতিটি দোকানের কর্মচারীর মধ্যে একজন হলেও বাংলাদেশি খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রতি বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব থেকে পরদিন বাদ জুমা পর্যন্ত হাজার হাজার বাংলাদেশি মিসফালাহ এলাকায় ভিড় করেন। তখন মনে হয় এ যেন–মরুর বুকে একখণ্ড বাংলাদেশ। এমন কি বাংলাদেশ হজ মিশনের অফিসও এ এলাকায় অবস্থিত। আরও রয়েছে বাংলাদেশ হজ মিশন মেডিকেল সেন্টার ও ক্লিনিক। যেখানে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারেন যে কেউ। বছরের বিশেষ দিনগুলোতে অনেক বাংলাদেশি পরিবার–পরিজন নিয়ে ছুটে আসেন এ এলাকায়। তাদের বিপুল উপস্থিতিতে পরিণত হয় মিলন মেলা। তাদের থাকা ও খাবারের আয়োজন এ এলাকার হোটেলগুলোতে হয়ে থাকে। এলাকার প্রতিটি সড়কে হেঁটে চলাচল করলে শোনা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষায় কথাবার্তা।
প্রবাসী বাংলাদেশীরা শুধু ব্যবসা বাণিজ্য ও আড্ডায় নিয়ে মশগুল থাকেন না, রাজনীতি নিয়ে তারা অত্যন্ত সচেতন।
মক্কার মিসফালাহ বাংলাদেশি হাজীদের জন্য একটি আবেগের নাম। যারাই সৌদি আরবে হজ বা ওমরা করতে আসেন, সবাই এই মিসফালার সাথে পরিচিত। তবে এখন মিসফালাহসহ বাইতুল্লাহর আশপাশের দোকানপাট উচ্ছেদ করে জায়গা ও রাস্তা প্রশস্ত করা হচ্ছে। সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে মিসফালাহ, সংকুচিত হচ্ছে বাংলাদেশিদের থাকার আস্তানা। তবুও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হাজীদের মিসফালাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি। মিসফালায় অবস্থানরত বিভিন্ন ব্যবসার সাথে জড়িত বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা শুধু বাংলাদেশি হাজীদের সেবা দিয়ে কান্ত হন না, বিশ্বের প্রত্যেক মুসলিম থেকে আগত হাজীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। ছোট্ট একটি জায়গা মিসফালায় এতবেশী বাংলাদেশি অবস্থানের কারণে মিসফালায় হয়ে ওঠে একটি মিনি বাংলাদেশ।