পাহাড়ের চূড়ায় ওঠলেই যেন আকাশ ছোঁয়া যায়। পাহাড়ের চারদিকে তাকালে মনে হয়, এ যেন এক অন্য পৃথিবী। এ পৃথিবীর সীমানা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। যতদূর চোখ যায়, রুক্ষ, সূক্ষ্ম, ন্যাড়া মরুময় পাথুরে পাহাড় আর পাহাড়। সৌদি আরবের পবিত্র মক্কায় অবস্থিত জারওয়াল পাহাড় মক্কা হারাম শরিফের নিকটেই। এই পাহাড়ের চূড়ায় ওঠলে খুব কাছ থেকে দেখা যায় বিশ্ব মুসলমানদের প্রাণ কেন্দ্র মক্কা হারাম শরীফ। মক্কা হারাম শরীফের পশ্চিমে জাবালে ওমরের শেষ প্রান্ত হতে দক্ষিণে মিসফালাহ টানেল, পূর্বে ইব্রাহীম খলিল রোড এবং পশ্চিমে টান্ডু বাঊই’র হারাতুল ইয়ামান সংলগ্ন সারে আল মনছুর ও সারে আল হাফায়া পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা নিয়ে জারওয়াল পাহাড়। মক্কায় হাজীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পর হাজীদের আবাসনের সুবিধার্থে মিসফালাহ ইব্রাহিম খলিল রোডের পশ্চিম পাশে জারওয়াল পাহাড়ের পাদদেশের এলাকা সরকার অধিগ্রহণ করে বিভিন্ন কোম্পানিতে লিজ দেওয়ার মাধ্যমে তারকা মানের দৃষ্টিনন্দন আবাসিক হোটেল নির্মাণ করে।
শত শত বছর ধরে হেজাজের স্থানীয় অধিবাসীরা এই জারওয়াল পাহাড়ে বসবাস করে আসছিল। পরে ইয়েমেনিরা ব্যবসা বাণিজ্যের লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে আসতে শুরু করে, তারা জারওয়াল পাহাড়কে তাদের বসবাসের ঠিকানা হিসেবে বেছে নেয়। ক্রমান্বয়ে সৌদি নাগরিকরা এই পাহাড় ছেড়ে আশেপাশে সমতলে তাদের স্থায়ী বসতি গড়ে তুলে।
আশির দশকে বাংলাদেশীরা সৌদি আরব আসা শুরু করে এবং কালের বিবর্তনে লাখ লাখ বাঙালি ভাগ্যন্বেষণের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে পাড়ি জমায়।
১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর ইয়েমেনিরা সৌদি আরব ছেড়ে চলে গেলে বাঙালিরা সৌদি আরবে ব্যাপকভাবে ব্যবসা শুরু করে। একইসাথে ইয়েমেনিদের আবাসস্থল জারওয়াল পাহাড়ে বাঙালিরা বসবাস শুরু করে। নব্বই’র দশকে মায়ানমারে সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন শুরু করলে শরনার্থী হিসেবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। আবার অনেক রোহিঙ্গা বিভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। নিপীড়িত নির্যাতিত জাতি হিসেবে সৌদি সরকার রোহিঙ্গাদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করে। ক্রমান্বয়ে তারা জারওয়াল পাহাড়কে তাদের বসবাসের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও বিভিন্ন বৈধ অবৈধ ব্যবসার কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কালক্রমে জারওয়াল পাহাড় হয়ে ওঠে দেশহীন, ঠিকানাহীন বার্মা ও বাঙালি বৈধ–অবৈধ অভিবাসীদের নিরাপদ ঠিকানা। এই কারণে জারওয়াল পাহাড় হয়ে ওঠে এক খণ্ড বার্মা। আবাসিক এলাকা ছাড়াও সস্তায় কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য প্রাপ্তির ঠিকানা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। মিসফালাহ, ইব্রাহিম খলিল রোডসহ হারাম শরিফের আশেপাশের বাঙালি ব্যবসায়ীদের বাসস্থানের ঠিকানাও জারওয়াল পাহাড়। জারওয়াল পাহাড়ে তুলনামূলকভাবে জিনিসপত্রের দাম অনেক কম। সস্তায় কাঁচাবাজার ও নিত্য ভোগ্যপণ্য সামগ্রী সওদার জন্যে বাইরে অনেক গ্রাহক জারওয়াল পাহাড়ের নিমতলী বাজারে ভিড় জমাতো। সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসেবে অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট সব উচ্ছেদ করে নতুনভাবে আর্কিটাকচারাল ডিজাইনে এখানে পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলা হবে। সৌদি আরব সাজবে নতুন সাজ। বাঙালি অন্য প্রবাসীদের সস্তায় থাকার দিন শেষ হয়ে আসছে।