ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ

৩০ বছর পরও অরক্ষিত বেড়িবাঁধ ।। উপকূলের মানুষ এখনো কাঁদে

আজাদী ডেস্ক | বৃহস্পতিবার , ২৯ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ। ১৯৯১ সালের এইদিনে বৃহত্তর চট্টগ্রামের উপকূল দিয়ে বয়ে গিয়েছিল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ‘ম্যারি এন’। সেদিন মধ্যরাতে আঘাতহানা এ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গিয়েছিল চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, সন্দ্বীপ এবং কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর, চকরিয়া ও পেকুয়াসহ উপকূলের ১৩টি উপজেলা। এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পুরো উপকূল। লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল চারদিকে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরিণত হয়েছিল ধ্বংস্তূপে। দেশের মানুষ সেদিন প্রকৃতির করুণ এ আঘাত প্রত্যক্ষ করে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেদিন উপকূলে আঘাত হানা ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়টির বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিমি (১৫৫ মাইল/ঘণ্টা)। এর প্রভাবে সৃষ্ট ২০/৩০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ্বাসে সেদিন সরকারি হিসাবে আনুমানিক ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৪২ জন মানুষ নিহত এবং প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রহীন হয়েছিলেন। মারা গিয়েছিল ২০ লাখ গবাদিপশু। ক্ষতি হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ। উপকূলবাসী আজও ভুলতে পারেনি সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি।
প্রলয়ঙ্করি এই ধ্বংসযজ্ঞের ৩০ বছর পার হতে চলেছে। এখনো স্বজন হারাদের আর্তনাদ থামেনি। ঘরবাড়ি হারা এলাকার মানুষ এখনো অরক্ষিত উপকূলে বর্ষায় নির্ঘুম রাত কাটান। তাদের দীর্ঘদিনের দাবি, স্থায়ী বেড়িবাঁধের মাধ্যমে উপকূল নিরাপদ করা। কিন্তু সেই দাবি এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে পূরণ হয়নি।
এদিকে প্রতিবছরের মত এবছরও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি স্মরণ করবে উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
আমাদের আনোয়ারা প্রতিনিধি জানান, উপজেলার গহিরা, রায়পুর, বারশত ও জুঁইদন্ডি এলাকায় ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা স্মরণ করে আজো হাজারো মানুষ নীরবে চোখের জল ফেলেন। সেদিন আনোয়ারায় ২২০ কিলোমিটার গতিবেগে বয়ে চলা ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারিয়েছিলেন ২০ হাজার মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। সেদিনের নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় এ বছরও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সীমিত আকারে কোরআনখানি, মিলাদ, দোয়া মাহফিল ও দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বেড়িবাঁধের অপেক্ষায় ৩০ বছর : ১৯৯১ সালের পর থেকে উপকূলবাসীর দাবি ছিল- টেকসই বেড়িবাঁধের। অবশেষে ২০১৮ সালে ভূমিমন্ত্রী ও আনোয়ারা-কর্ণফুলী সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি সেই দাবি আমলে নিয়ে ৫৭৭ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্পের কাজ শুরু করেন। ইতোমধ্যে প্রকল্পের দুই তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রকৌশলী দয়াল কুমার ত্রিপুরা জানান, রায়পুর, বারশত, জুঁইদন্ডী, বারখাইন, হাইলধর ইউনিয়নে তিনটি প্যাকেজের বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। তাছাড়া চাতরী-কৈইখাইন এলাকার খালের বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজও চলমান রয়েছে। বর্তমানে আনোয়ারায় ৫৭৭ কোটি টাকার বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ চলছে। ইতোমধ্যে পুরো প্রকল্পের ৬৬% কাজ শেষ হয়েছে। আগামী একমাসের মধ্যে বাকি কাজও শেষ হবে বলে আশা করছি।
সরেজমিনে গতকাল বুধবার উপকূলীয় এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, রায়পুর ইউনিয়নের বাইন্নার দিঘী, ফকির হাট, ঘাটকূল, বার আউলিয়া, উত্তর গহিরা, দক্ষিণ গহিরা, মধ্যম গহিরা, পরুয়াপাড়া ফুলতলী এলাকাসহ উপকূলে চলছে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ। স্থানীয় বিদ্যালয়ে প্রবীণ শিক্ষক মৌলানা আবদুর রহিম বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন একটি টেকসই বেড়িবাঁধের। এখন বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ চলছে। এতে আমরা খুবই আনন্দিত।
রায়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জানে আলম জানান, ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে এই ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ পানিতে ভেসে গিয়েছিল। সেদিন থেকে এলাকার মানুষের একটাই দাবি ছিল- টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের। আজ সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে।
আনোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী জানান, ১৯৯১ সালে পুরো উপকূল জুড়ে ছিল লাশ আর লাশ। সেদিনের সে দুঃস্মৃতি এখতো আমাকে তাড়ায়। আজ ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপির প্রচেষ্টায় ৫৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ চলছে। এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে উপকূলবাসীর ভাগ্য বদলে যাবে।
আমাদের সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি জানান, ২৯ এপ্রিল মধ্যরাতে আঘাতহানা প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল সীতাকুণ্ডের সলিমপুর থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত ৯টি ইউনিয়ন। প্রায় ২২৫ কিলোমিটার গতিবেগ সম্পন্ন ও ৩০-৩৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে উপকূল পরিণত হয়েছিল বিরাণ ভূমিতে। এসময় মারা গিয়েছিল এলাকার প্রায় সাত হাজার মানুষ। আর নিখোঁজ হয়েছিল প্রায় তিন হাজার শিশু-নারী-পুরুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় তিনশত কোটি টাকার সম্পদ। ভয়াল সেই রাতের ৩০টি বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু উপকূলের আংশিক বেড়িবাঁধ সংস্কার হলেও এখনো এলাকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
কুমিরা, বাঁশবাড়িয়া, সোনাইছড়ি, ভাটিয়ারিসহ কয়েকটি উপকূলীয় এলাকা ঘুরে বিভিন্ন লোকের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ৩০ বছরে উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের নামে কয়েক’শ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাঁশবাড়িয়ার বোয়ালিয়াকূল বেড়িবাঁধ দীর্ঘদিন পর সংস্কার হলেও এর স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক বছর না যেতেই বাঁধটি পুনরায় ভাঙ্গতে শুরু করেছে।
বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীর এ প্রসঙ্গে বলেন, অনিয়ম দুর্নীতি প্রতিরোধ করা যায় না বলে এই দুরবস্থা। ৩০ বছর এর মাশুল দিচ্ছে এলাকার ৫০ হাজার মানুষ। তবে সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে বোয়ালিয়াকূল থেকে আকিলপুর পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার বেডিবাঁধ সংস্কার করলেও নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের কারণে এটি আবার ভেঙ্গে যাচ্ছে।
এছাড়া সীতাকুণ্ডের পৌর এলাকাসহ ৯টি ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকায় শতাধিক আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের কথা থাকলেও হয়েছে মাত্র ৬১টি। আবার সেখানে অনেকগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সলিমপুর থেকে বাঁশবাড়িয়া পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকা দেখা গেছে, শিপইয়ার্ড নির্মাণ করতে গিয়ে ওইসব এলাকায় বনায়ন ধ্বংস করা হয়েছে। ১৯৯১ সালের মতো পুনরায় যদি এসব এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস দেখা দেয় তাহলে আরো ব্যাপক প্রাণহানিসহ সম্পদ ক্ষতিসাধনের সম্ভাবনা রয়েছে।
সীতাকুণ্ড উপজেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আব্দুর রহিম জানান, উপকূলীয় এলাকার মানুষের অনুপাতে আশ্রয় কেন্দ্র অপ্রতুল। যেগুলি নির্মিত হয়েছে সেগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নির্মাণের সময় সঠিক পরিকল্পনার অভাবে অধিক সংখ্যক লোক আশ্রয় নিতে পারে না।
আমাদের মহেশখালী প্রতিনিধি জানান, ’৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে মহেশখালীতেও ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল। ঘটনার ৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও উপকূলের বেড়িবাঁধসমূহ এখনো সুরক্ষিত করা যায়নি। মহেশখালী ধলঘাটা ও মাতারবাড়ীর পশ্চিমাংশ এবং কুতুবদিয়ায় বেড়িবাঁধের অবস্থা খুব শোচনীয়। এ প্রসঙ্গে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মহেশখালী- কুতুবদিয়া উপকূলীয় জনগণের জানমাল রক্ষার্থে বেড়িবাঁধের যথেষ্ট উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। তবে ধলঘাটা মাতারবাড়ী ও কুতুবদিয়ায় যেগুলো সংস্কার প্রয়োজন সেগুলো সংস্কার করা হবে।
আমাদের চকরিয়া প্রতিনিধি জানান, ২৯ এপ্রিল রাতে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে চকরিয়া-পেকুয়ায় অন্তত ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একই সঙ্গে মারা গেছে লাখ লাখ গবাদি পশু। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ৩০ বছর কেটে গেলেও চকরিয়া-পেকুয়ায় ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ টেকসই করা যায়নি। মাঝেমধ্যে বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও তা প্রতিবছর জোয়ারের পানিতে বিলীন হয়ে যায়।
স্থানীয়রা জানান, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও জনপ্রতিনিধিরা অন্তত ১৫ দিনব্যাপী এসব লাশ উদ্ধার করে গণকবর দিয়েছিলেন। ৩০ বছরের ব্যবধানে উপকূলীয় এলাকার এসব গণকবরের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময় দেশি-বিদেশি অর্থায়নে শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও দেখভালের অভাবে সেগুলো দিন দিন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে চকরিয়া-পেকুয়ার পাঁচ লাখ মানুষ এখনো বসবাস করছেন চরম ঝুঁকিতে।
পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে মগনামা, রাজাখালী ও উজানটিয়া। এর মধ্যে একেবারে সাগরগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে মগনামার কিছু অংশ।
কঙবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, উপকূলের মানুষকে রক্ষায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য কাজ চলমান রয়েছে। অবশ্য পেকুয়ার মগনামা ইউনিয়নের বিশাল এলাকা আগে অরক্ষিত থাকলেও সেখানে দেশের প্রথম বানৌজা শেখ হাসিনা সাবমেরিন নৌ-ঘাটি স্থাপন হওয়ায় টেকসইভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বেড়িবাঁধ। এতে অনেকবছরে দুঃখ লাঘব হয়েছে উপকূলের মানুষের। এছাগা ডেল্টা প্ল্যান অনুযায়ী সমুদ্র উপকূল রক্ষায় অনেক উচ্চতায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজও শুরু হবে আগামীতে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কঙবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, কঙবাজারের উপকূলজুড়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। আগে বরাদ্দ প্রাপ্তি নিয়ে যেসব সমস্যা দেখা দিতো বর্তমানে সেই অবস্থা নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে চসিক-বন্দর বৈঠক আজ
পরবর্তী নিবন্ধব্যাংকে লেনদেন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা