পরীমনি, হিরো আলম, হারুন কিসিঞ্জার, মেরা মিয়া, লাল মিয়া, গেঁদা মিয়া, সোনা মিয়াসহ ইউটিউব ভাইরাল নিয়ে মজে আছে দেশের অসংখ্য মানুষ। আরো আছে লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিডনি, টরেন্টোতে দেশ বদলানোর গজব ভাষ্যকার কিছু প্রবাসী অব: সেনাকর্তাসহ বহুৎ বাঙালি ক্যারিকেচার! এদের যাদু বয়ান, ভয়ঙ্কর গাঁজার চাষ ও হুঙ্কারে মনে হবে, কালই সরকার পতন হচ্ছে, নিশ্চিত! হুজুর, মোল্লার গর্জন না হয় বাদ। গজব, গ্ল্যামার, ভংচংয়ের হাজার, বিজার, লাখ-লাখ দর্শক দেখলে মাথা চক্কর খায়! এর বাইরে আরো কতকিছু ভাসছে সোসাল মিডিয়া ও মূলধারায়।
আসল সর্বনাশ যে দোরগোড়ায়, এই খবর কারো নেই। সরকার, রাজনীতিক, মিডিয়া, ভাষ্যকার, বুদ্ধি পন্ডিত কারো না। সামান্য বৃষ্টির স্রোতে চিরতরে নালায় হারিয়ে যাওয়া একজন হতভাগ্য ছালেহ আহমেদও আমাদের চোখ খুলে দিতে পারেননি। চট্টগ্রাম নগরীর ইতিহাসে স্থায়ী কলঙ্কের দাগ হয়ে থাকবে ছালেহ আহমেদের নালার স্রোতে ডুবে অবিশ্বাস্য অন্তর্ধান। দেড় দু’সপ্তাহ টানা উদ্ধার অভিযান চালিয়েও ব্যবসায়ী ছালেহ আহমেদের লাশটি শোকার্ত পরিবারের কাছে তুলে দিতে পারেননি, ফায়ার ব্রিগেডের উদ্ধারকারী দল। নিশ্চয়ই তার লাশ দাফন হয়ে গেছে পলিথিন বর্জ্যের গুদামের ভেতর! ভাগ্যাহত পরিবারের সদস্যদের সারাজীবন অসহনীয় এই অন্তর্জ্বালা বয়ে বেড়াতে হবেই। আমার, আপনার কিছুই যায় আসে না। আসলে কী তাই? না, আমরাও তলিয়ে যাওয়ার ক্ষণ গুণছি। দ্রুতই এগিয়ে আসছে মনুষ্যসৃষ্ট কেয়ামত। পলিথিন ও অপচনশীল বর্জ্য নিয়ে কাজ করা নরওয়েভিত্তিক একটি পরিবেশবাদী গবেষণা সংস্থা আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর এক উপহার এনেছে। “গ্লোবাল ইমপ্যাক্ট: পলি অ্যান্ড সিনথেটিক ওয়েস্টেজ” শীর্ষক তাদের সামপ্রতিক গবেষণা রিপোর্টে বলেছে, বঙ্গোপসাগরে প্রতিদিন ২ ট্রিলিয়ন (দু’হাজার কোটি) ছোটবড় পলিবর্জ্য জমছে। গবেষণায় দক্ষিণ এশীয় চ্যাপ্টার নিয়ে কাজ করা সংস্থার গবেষক দল টানা তিন মাস অনুসন্ধান চালিয়ে প্রতিবেদনটি সংস্থার কাছে জমা দিয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা নদীসহ দেশের সব নদ-নদী, ছোটবড় খাল দিয়ে প্রবাহিত বর্জ্যগুলো সাগরে জমছে। এর অর্ধেক বা এক ট্রিলিয়ন উজানের দেশগুলোর বর্জ্য, বাকী অর্ধেক দেশের। অপচনশীল পলি বর্জ্যগুলো সাগর উপকূল থেকে অন্তত ২৫ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত দ্রুত ভরাট করে দিচ্ছে। সাগর ভরাট হওয়ার পাশাপাশি সাগরের মৎস্য, জলজ প্রাণী, উদ্ভিদসহ অন্যান্য সমুদ্র সম্পদকে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বৈশ্বিক উঞ্চায়নের প্রভাবের পাশাপাশি পলি ও সিন্থেটিক বর্জ্য সমুদ্র পৃষ্ঠকে দ্বিগুণ স্ফীত করে দেবে। এতে আগামী ৩০/৪০ বছরের মাঝে চট্টগ্রাম নগরীর বড় অংশসহ উপকূলের অর্ধেকের কাছাকাছি তলিয়ে যেতে পারে। অচল হয়ে পড়তে পারে চট্টগ্রাম বন্দরসহ আরো কিছু বড় স্থাপনা।
প্রতিবেদনটি সংস্থার কারিগরি কমিটি যাছাই-বাছাই শেষে শিগগিরই প্রকাশ করতে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উঞ্চায়ন এমনিতে অসহনীয় পর্যায়ে বেড়ে গেছে। ভাঙছে অ্যান্টার্কটিকার বরফ স্তর। অতি সমপ্রতি অবিশ্বাস্য কান্ড ঘটেছে গ্রিনল্যান্ডের গভীর বরফ ঢাকা পর্বতে। হঠাৎ ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে পর্বত চূড়োয়। ৫০ হিমাঙ্কেরও নিচে ঠান্ডা বরফঢাকা পর্বতে বুষ্টিপাত গ্রীনল্যান্ডের ইতিহাসে এবারই প্রথম। বৃষ্টির উঞ্চতায় পর্বতের বরফ চুড়োয় সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য বড়-বড় ফাটল, গলছে বরফ। সব মিলিয়ে অবস্থা জটিল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্ব জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে যাবার পর বিশ্বের উঞ্চায়ন মারাত্মকভাবে বাড়ছে। এর প্রভাব এরমাঝে চট্টগ্রামে ভালভাবেই পড়ছে। এক ঘন্টার মাঝারি বৃষ্টিতেই ডুবছে নগর। জোয়ার জলে ভাসে নিম্নাঞ্চলসহ বড় একটি অংশ। অবস্থা আরো জটিল করে দিয়েছে, নদী, খাল, নালা-নর্দমায় পলিথিন বর্জ্যের ভয়াবহ চাপ। সিটি মেয়র এম, রেজাউল করিম চৌধুরী নিজেই স্বীকার করেছেন, বর্জ্য অপসারণের এক সপ্তাহের মাঝে পলিথিন ও অপচনশীল বর্জ্য জমে খাল নালা আবর্জনার ভাগাড় হয়ে যাচ্ছে। পলিথিন বর্জ্যের সাথে যুক্ত হয়েছে, পাহাড় কাটা মাটি ও বালি। কর্ণফুলীসহ সব নদী, নালা, খালের অবৈধ দখল বাণিজ্যও। কথা হচ্ছে, চট্টগ্রাম নগরীই যদি না বাঁচে, অবৈধ দখল ও লুটপাটে অর্জিত বিপুল সম্পদ কার ভোগে যাবে? পলিথিন কারখানা ও বাণিজ্যইবা কার স্বার্থে? পলিথিন ও সিন্থেটিক পণ্য পুরো দেশকে ধীরে ধীরে রাক্ষসের মত গিলে নিচ্ছে। সাগর উপকূলের তলদেশ থেকে পলিথিন জঞ্জাল অপসারণ করবেইবা কে? পলি কারখানা ও ব্যবহার বন্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা গড়ে দেশ বাঁচাতে হবেই। উন্নত দেশগুলোতে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবীরা উপকৃল ও নগর সাফ করে নিয়মিত, আমরা করি দূষিত! তো, কীভাবে বাঁচবে দেশ এবং চট্টগ্রাম?