গত ১১ সেপ্টেম্বর নারায়নগঞ্জের বন্দর উপজেলা হতে র্যাব–১১– অস্ত্রশস্ত্র ও ইয়াবাসহ পাঁচজন সন্ত্রাসীকে আটক করে। তাঁদের দলে ‘শ্রাবণ‘ নামের ১৮ বছরের এক কিশোরী ছিল– যে ছেলেদের ছদ্মবেশেই দলে ছিল। তাঁর এই ছদ্মবেশ শুধু দলনেতাই জানতো। পিস্তল হাতে এই কিশোরীর বিভিন্ন ভঙ্গির ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুবক–কিশোরদের এই সন্ত্রাসী গ্যাং এলাকায় মাদকসেবন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাস্তানি করে বেড়াতো।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে, বিগত ৫/৬ বছর ধরে ঢাকা–চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ত্রাস জগতে নতুন অপরাধ সংস্কৃতির জন্মলাভ করেছে, যার নাম ‘কিশোর গ্যাং‘। যারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই, মাস্তানি, মোটরসাইকেলের ভীতিকর মহড়া দেয়া, ইয়াবা সেবন ও বিক্রয়, নারীদের উত্ত্যক্ত করা, দলের মিছিল–মিটিং করা, বড়ভাই বা গডফাদারদের ফাইফরমাশ পালন করা ইত্যাদি অনৈতিক কাজ ও অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে। যে বয়সে এই কিশোরদের স্কুল–কলেজে থাকার কথা, সে সময় তাঁরা অপরাধের সাথে যুক্ত হয়েছে। যে বয়সে তাঁদের হাতে বইখাতা থাকার কথা, সে বয়সে তাঁদের হাতে আমরা ইয়াবা দেখছি। যে বয়সে হাতে কলম থাকার কথা সে বয়সে পিস্তল–চাকু শোভা পাচ্ছে। যা অবশ্যই দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে।
প্রশ্ন হলো, হঠাৎ কিশোরদের মধ্যে ‘অপরাধে জড়িত হওয়ার‘ প্রবণতা বাড়লো কেন? এর উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে– কোন সুনির্দিষ্ট একটি কারনে আজকের কিশোর অপরাধীরা জন্মলাভ করেনি। পরিবর্তনশীল বিশ্বের ইন্টারনেট সংস্কৃতির সহজলভ্যতার কারনে হলিউড–বলিউডের ‘সন্ত্রাস নির্ভর চলচ্চিত্র‘ সবার হাতের মোবাইলে এখন দৃশ্যমান। এসব সন্ত্রাস নির্ভর চলচ্চিত্র সমাজে অপরাধীর জন্ম দিচ্ছে। তবে আমাদের দেশে কিশোর অপরাধী বৃদ্ধির আরও কিছু কারণ রয়েছে। যা সামান্য বিশ্লেষণ করলে বুঝা যাবে। যেমন– স্বাধীনতার পর নব্বই‘র দশক পর্যন্ত কিশোর অপরাধের এমন ভয়ানক চিত্র দেখা যায় নি। কিন্তু এরশাদ সাহেব যেই নির্বাচনী ফলাফল প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ভোটকেন্দ্র দখলের জন্য ‘হোন্ডা–গুন্ডাদের উপর ভরসা করতে শুরু করলেন‘, তখন থেকে দেশের অপরাধের ধরনও পাল্টে যায়। মাঝখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অপরাধ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও পরবর্তী সরকার সমূহের ‘ক্ষমতা ধরে রাখার‘ মানসিকতার কারণে আবারও সন্ত্রাসীদের কদর বেড়ে যায়। কারণ নির্বাচনী মাঠ দখলের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সন্ত্রাসীদেরও প্রয়োজন পড়ে। তারা (সন্ত্রাসীরা) নিজেরা শক্তি সঞ্চয় করে এবং শক্তি বাড়ানোর জন্য স্ব স্ব এলাকায় নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলে। আর ক্যাডার বাহিনীতে যুবকদের পাশাপাশি ‘কিশোরদের‘ও তারা দলে ভিড়ানোর জন্য নানা প্রলোভন দেখাতে থাকে। ফলে কচিমনের অপরিপক্বতার কারণে এবং হিরোইজমের স্বপ্নে বিভোর হয়ে কিশোররা বড়ভাই তথা গডফাদারদের দলে যোগ দেয়, যা পরে ‘কিশোর গ্যাং‘-এ পরিণত হয়। পুলিশের ভাষ্যানুযায়ী শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৫০ টির অধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় আছে। এবং তারা প্রতিনিয়ত কোন না কোন অপরাধ সংঘটিত করছে। চট্টগ্রামেও আমরা কিশোর গ্যাং–এর উপস্থিতি লক্ষ্য করে থাকি।
আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে, কিশোর গ্যাং–এর সদস্যদের পিতা–মাতা বা অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন। ছেলে কোথায় যায়, কী করে, কার সাথে মিশে, কোথায় রাতযাপন করে – এসব বিষয়ে তাঁদের মাথাব্যথা কম। তাই ছেলেরাও ধীরেধীরে পুরোপুরি অপরাধের সাথে জড়িয়ে যায়। তাছাড়া ইয়াবা‘র মত মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতাও অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোর অপরাধীদের একটি অংশ অভিভাবকহীন, অর্থাৎ তারা বস্তি এলাকা হতে উঠে এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সঠিক ‘ডাটাবেজ‘ না থাকার কারণেএদের শনাক্ত করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। উন্নত দেশে অপরাধ কম হওয়ার কারণ হলো– ‘অপরাধী চিহ্নিত করার জন্য তাঁদের রয়েছে শক্তিশালী আধুনিক যন্ত্রপাতি‘। যার সাহায্যে তাঁরা দ্রুত অপরাধীকে পাকড়াও করতে পারে। উন্নত দেশে অপরাধীকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য কেউ তদবির করে না, যা আমাদের দেশে আমরা সচরাচর দেখে থাকি। সেখানে (উন্নত দেশে) অপরাধীরা জানে, অপরাধ করলে তাঁর রেহাই নেই। আর আমাদের দেশের অপরাধীরা বিশ্বাস করে যে, অপরাধ করলে তার কিছু হবে না, তাকে তার বড়ভাই বা নেতা বা গডফাদার অবশ্যই ছাড়িয়ে নেবে। মূলত এই বিশ্বাসই অপরাধ বৃদ্ধির বড় কারণ। অর্থাৎ অপরাধের বিচারের অনিশ্চয়তাও অপরাধ বাড়িয়ে দেয়।
যে কারণেই হোক, কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির এই চিত্র– দেশ ও জাতির জন্য ভয়ানক রকমের দুশ্চিন্তার কারণ। যারা কিশোর অপরাধীদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দেন বা দিচ্ছেন, তাঁরা মনের অজান্তেই দেশের মারাত্মক ক্ষতি করছেন। এরফলে আগামী প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে।
কিশোর গ্যাং কালচার বা কিশোর অপরাধ বন্ধ করার জন্য আমাদের রাজনীতিকদেরকেই মূল বা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। তাঁদের বাড়িতে যেন কোন ‘কিশোর‘ যেতে না পারে, সে নির্দেশ দিতে হবে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও রাখতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সন্ধ্যার পর দলবদ্ধ কিশোরদের রাস্তাঘাটে–মার্কেটে আড্ডারত দেখলেই কৈফিয়ত চায়তে হবে এবং ঘরে যাওয়ার জন্য বাধ্য করতে হবে। কিশোর অপরাধীদের জন্য পর্যাপ্ত রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোন কিশোর অপরাধীকে গ্রেফতার করা হলে, সে যেন আইনের সঠিক আশ্রয় পায়(সঠিক বিচার হয়) সে ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের অভিভাবকদের তাঁদের ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সন্তান কোথায় যায়, কি করে– তা সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকা পিতা–মাতার নৈতিক দায়িত্ব। আমরা আশা করব–রাজনীতিক, সরকার, সমাজ ও পরিবারের সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে কিশোর গ্যাং কালচার সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং দেশ ও জাতি আগামী দিনের অপরাধের মারাত্মক হুমকি হতে রক্ষা পাবে।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী