কেউ ভ্রমণ করে, কেউ ভ্রমণ সাহিত্য পড়ে, আবার কেউ সাহিত্যভ্রমণে যায়। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, আমরা প্রায় সবাই কমবেশি ভ্রমণপিপাসু। ভ্রমণে যাওয়ার অকৃত্রিম ইচ্ছে সবার মনে খেলা করে। প্রায় সকলেই লালন করে ভ্রমণের তৃষ্ণা। সেই তৃষ্ণাকে তৃপ্ত করেন অনেকে। কেউ পারেন, কেউ পারেন না। ভ্রমণের জন্য প্রয়োজন তিনটি ‘স’ : সময়, স্বাস্থ্য ও সামর্থ্য। এই তিন ‘স’–এর সমন্বয় ঘটাতে পারলেই ভ্রমণ–তৃষ্ণার পরিসমাপ্তি হবে। আমাদের দেশে একজন লেখক আছেন, যিনি বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ হলেও এখনো সাহিত্যের বিচিত্র ভুবনে পরিভ্রমণ করছেন। গল্প–উপন্যাসের পাশাপাশি লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনি। দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ভ্রমণসমগ্র। তিনি হলেন হাসনাত আবদুল হাই। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। কাজের সুবাদে দেশ–বিদেশে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে। সঞ্চয় করেছেন লেখার বিপুল রসদও। ফলে অপূর্ব সব ভ্রমণকাহিনি বেরিয়েছে তাঁর হাত থেকে।
আমাদের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মতো ভ্রমণসাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভ্রমণ সাহিত্য বিষয়ক লেখাগুলোতে আমরা প্রত্যক্ষ করি তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও প্রয়াস। ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’, ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরী’, ‘পথের সঞ্চয়’, ‘জাপান যাত্রী’, ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরী’, ‘রাশিয়ার চিঠি’ প্রভৃতি বইগুলো আমাদের তৃপ্ত করে। এসব বইয়ে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন স্থানের বর্ণনা, সাংস্কৃতিক পরিচয়ের পাশাপাশি সেসব স্থানের ‘অন্তর্লোকের দিকটিও’ ফুটিয়ে তুলেছেন।
যদিও বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক ভ্রমণসাহিত্য রচয়িতা হিসেবে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেই বলা হয়ে থাকে। তাঁর ভ্রমণকাহিনির নাম ‘পালামৌ’। সুকুমার সেন ‘পালামৌ’ সম্পর্কে বলেছেন, “বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড় ভাই সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’কে বাংলা গদ্য সাহিত্যে প্রথম সার্থক ভ্রমণকাহিনি হিসেবে গণ্য করা যায়।”
বাংলা ভ্রমণসাহিত্যিকদের নাম বললে অবারিতভাবে দুটো নাম চলে আসে। নাম দুটো হলো সৈয়দ মুজতবা আলী ও অন্নদাশঙ্কর রায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত সৃষ্টি ‘দেশে বিদেশে’। তাঁর ভ্রমণ–সাহিত্য জীবন ঘনিষ্ঠ ও রসসিক্ত। তাঁর ভাষা ও রচনাশৈলী অনন্যসাধারণ হয়ে ধরা দিয়েছে পাঠকের কাছে। অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলা সাহিত্যে নিপুণ ছড়াশিল্পী হিসেবে স্বনামে খ্যাত। কিন্তু তাঁর ‘পথে প্রবাসে’ বাংলা ভ্রমণসাহিত্যের এক উজ্জ্বল সংযোজন।
এছাড়া আমরা পাই জসীম উদ্দীনের ভ্রমণবিষয়ক বই ‘চলে মুসাফির’, ‘হলদে পরির দেশে’, ‘যে দেশে মানুষ বড়’; পাই বুদ্ধদেব বসুর ‘আমি চঞ্চল হে’, ‘সব পেয়েছির দেশে’; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘ছবির দেশে, কবিতার দেশে’র মতো অসামান্য সৃষ্টি।
বাংলা ভ্রমণ–সাহিত্যে আরো কিছু বইয়ের উল্লেখ করতে পারি। যেমন– শঙ্খ ঘোষের ‘সীমান্তবিহীন দেশে দেশে’, হুমায়ূন আহমেদের ‘রাবণের দেশে আমি ও আমরা’, ‘পায়ের তলায় খড়ম’, ‘উঠোন পেরিয়ে দুই পা’; নবনীতা দেবসেনের ‘ভ্রমণসমগ্র’; ইমদাদ হকের ‘সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে’। এক্ষেত্রে অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত তিন খণ্ডের ‘সেরা ভ্রমণ কাহিনী’ ও আশরাফুজ্জামান উজ্জল সম্পাদিত ‘ভ্রমণের খেরোখাতা’র কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
আমাদের দেশে অনেকে ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন, লিখছেন। বইও প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন ফারুক মঈনউদ্দিন, সেলিম সোলায়মান, আনোয়ারা আলম, জিনাত আজম, রেফায়েত ইবনে আমিন, হাসান আকবর, ফারহানা তেহসীন প্রমুখ।
বলা হয়ে থাকে, ‘জীবন ও জগৎ’ দেখার অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃষ্টিকোণ না থাকলে সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয়। ভ্রমণসাহিত্যের ক্ষেত্রে এই একই প্রত্যয় ও অঙ্গীকার থাকতে হয় বলে লেখকরা তাঁদের রসবোধ সঞ্চার করেন সাহিত্যে। পটভূমি আর পরিপার্শ্বকে বিশ্বস্ত করে চিত্রায়ন করেন একটার পর একটা দৃশ্য। সেই দৃশ্য দেখে দেখে পাঠকরাও উপভোগ করেন ভ্রমণের আনন্দ।
আমরা কয়েক বছর ধরে আয়োজন করছি ‘সাহিত্যভ্রমণের’। চট্টগ্রাম একাডেমির উদ্যোগে প্রতিবছর বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলায় অংশগ্রহণ, স্টল পরিদর্শন ও লেখক আড্ডায় সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এবার ১৫ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের প্রায় শতাধিক লেখক, সাহিত্যকর্মী এ ভ্রমণে অংশ নিয়ে বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলায় যাচ্ছেন। তাঁরা সকালে বাসযোগে যাত্রা করবেন এবং বিকেল নাগাদ বইমেলায় পৌঁছে মেলা পরিদর্শন করবেন। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় ‘সাহিত্যভ্রমণের’ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বিভিন্ন মিডিয়ার মুখোমুখি হবেন এবং তাঁদের সদ্য প্রকাশিত বই নিয়ে কথা বলবেন। এঁদের উদ্যোগে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে পরদিন ১৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টায় অনুষ্ঠিত হবে অধ্যাপক খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান ও শিশুসাহিত্যিক মিলনমেলা। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটনের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি থাকবেন বরেণ্য শিশুসাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম, সুজন বড়ুয়া, রহীম শাহ, মোহাম্মদ জহির প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করবেন আমিনুর রশীদ কাদেরী।
শিশুসাহিত্যিক মিলনমেলার আয়োজনের উদ্দেশ্য হলো আমাদের শিশুসাহিত্যের প্রবহমান ধারাকে বেগবান করা এবং দেশের শিশুসাহিত্যিকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন ও ভাবনাবিনিময় করা। শুধু দেশের নয়, ওপার বাংলার শিশুসাহিত্যিকরাও এই মিলনমেলায় অংশ নিয়ে আমাদের উদ্যোগকে প্রাণিত করতে পারেন।
আমরা জানি, সময়ের বিবর্তনের ধারায় ক্রমশ বদলে যায় চারপাশের জগৎ ও জীবন। পাল্টে যায় সমাজ, সংস্কৃতি, শিল্প–সাহিত্যের ধারা। এই বদলে যাওয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিশুসাহিত্যও ধীরে ধীরে পাল্টে ফেলছে। রচনার বিষয়–বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিবর্তন ঘটছে তার গতি–প্রকৃতি। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন প্রকরণ, সৃষ্টি হচ্ছে নতুন ধারার রচনা এবং নির্মাণ হচ্ছে নতুন আঙ্গিক। এজন্য পূর্বের ধ্যান ধারণারও পরিবর্তন ঘটছে। শিশুসাহিত্য একান্তভাবে ছোটোদের জন্য লেখা হলেও সব বয়সের পাঠকের কাছেই তা পরম আস্বাদ্য। বুদ্ধদেব বসু অনেক আগেই বলেছেন, ‘এমন মত পোষণ করা সম্ভব যে শিশুসাহিত্য স্বতন্ত্র কোনো পদার্থ নয়, কেননা তা সত্যিকার সাহিত্য হলে বড়রাও তাতে আনন্দ পান’। ‘বাংলা শিশুসাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি শিশুসাহিত্যের ভোক্তা–বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন। বুদ্ধদেব লিখেছেন : বর্তমান কালের ছোটোদের বই অনেক ক্ষেত্রে বয়স্করাও উপভোগ করে থাকেন। কথাটাকে একটু বিস্তার করা দরকার। শিশুসাহিত্যে বড় দুটো শ্রেণি পাওয়া যায়। তার একটা হলো একান্তভাবে, বিশুদ্ধরূপে নাবালক সেব্য, যেমন যোগীন্দ্রনাথের, উপেন্দ্র কিশোরের রচনাবলি, আর অন্যটা হলো সেই জাতের বই, যাতে বুদ্ধির পরিণতিক্রমে ইঙ্গিতের গভীরতা বাড়ে, যেমন ক্যারলের অ্যালিস–কাহিনি, অ্যান্ডারসনের রূপকথা, বাংলা ভাষায় ‘বুড়ো আংলা’ ‘আবোল তাবোল’। যাদের মনের এখনও দাঁত ওঠেনি, একেবারে তাদেরই জন্য প্রথম শ্রেণির রচনা। তাদের ঠিক উপযোগী হলেই তা সার্থক হলো: কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির রচনা, বিশেষ অর্থে, শিশুপাঠ্য থেকেও, হয়ে ওঠে বড় অর্থে সাহিত্য, শিল্প কর্ম, অর্থাৎ লেখক ছোটোদের বই লিখতে গিয়ে নিজেরই অজান্তে সকলের বই লিখে ফেলেন। বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক শিশুসাহিত্য, যা বয়স্করাও উপভোগ করেন।
আশা গঙ্গোপাধ্যায়ও ‘শিশুসাহিত্যের স্বরূপ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘যথার্থ শিশুসাহিত্য বলিতে তাহাই বুঝিব, যাহা র্স্ব বয়সের নরনারীর কাছেই একটি রসাস্বাদ আনিয়া দেয়, বয়সের পার্থক্য অনুসারে আস্বাদনের ব্যাপারে কিছু বিভিন্নতা ঘটিতে পারে–কিন্তু সর্ব্বস্তরের মানুষকে আনন্দ দান করিবার মত শিল্পগুণ তাহাতে থাকিবেই।’ অতএব, আমরা বলতে পারি, যে কোনো মহৎ সাহিত্য যেমন সরস ও সুস্বাদু হবার পাশাপাশি বৃহত্তর জগতের সন্ধান দেয়, তেমনি যথার্থ শিশুসাহিত্যে আনন্দরসের মাধ্যমে প্রতিভাত হয় চারপাশের জগৎ ও জীবন। এটি চিরায়ত সাহিত্য। সব শ্রেণির পাঠক এর ভোক্তা। তাই সব শ্রেণির পাঠককে সঙ্গে পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি যুথবদ্ধভাবে। এবারের ‘শিশুসাহিত্যিক মিলনমেলা’ দেশের শিশুসাহিত্যকর্মীদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করবে– এমন প্রত্যাশা আমরা করতে পারি।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো
(নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।