করোনাভাইরাস মহামারি থেকে মুক্তি পেতে ভ্যাকসিনের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্ব। এখন পর্যন্ত কোনো টিকা অনুমোদন না পেলেও ধনী দেশগুলোর মাঝে অগ্রিম টিকা কেনার প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। এ অসম প্রতিযোগিতায় দরিদ্র এবং মধ্যম আয়ের দেশের মানুষের টিকা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
করোনার কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন এখনো আসেনি। কিন্তু পরীক্ষা–নিরীক্ষা পর্যায়ে অগ্রিম কোটি কোটি ডোজ কিনে রাখছে ধনী দেশগুলো। দাতব্য সংস্থা অক্সফামের সামপ্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ধনী দেশগুলো সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের উৎপাদন সক্ষমতার ৫১ শতাংশই কিনে ফেলেছে। কিন্তু ওই দেশগুলোতে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষের বসবাস। খবর বিবিসি বাংলার।
ধনী দেশের এই কাড়াকাড়ির কারণে আবিষ্কারে এগিয়ে থাকা ৫টি ভ্যাকসিনও যদি সফল হয়, তবু ২০২২ সালের আগে বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ বা ৬১ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন নিতে পারবে না অক্সফাম। আবিষ্কারে এগিয়ে থাকা ৫টি ভ্যাকসিনও যদি নিরাপদ প্রমাণিত এবং সফল হয়, তারপরও এ অবস্থা সৃষ্টি হবে বলে সতর্ক করে অক্সফাম।
চলমান জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের শুরুতে দেওয়া বক্তব্যে ভ্যাকসিনের আলাদা চুক্তিকে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ উল্লেখ করে একে অন্যায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন মহাসচিব। বিশ্বে এই মুহূর্তে ল্যাবে শত শত ভ্যাকসিন গবেষণা হচ্ছে। তবে ৪০টি ভ্যাকসিন আছে হিউম্যান ট্রায়াল পর্যায়ে। ১০টি ভ্যাকসিন তৃতীয় ধাপে বড় জনগোষ্ঠীর ওপর পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছে। এর মধ্যে চীন ও রাশিয়া ৫টি ভ্যাকসিন সীমিত আকারে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
আইসিডিডিআরবির এমিরেটাস বিজ্ঞানী এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিন বিষয়ক বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ড. ফেরদৌসী কাদরী বলেছেন, ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য কিন্তু অনেক প্রতিযোগিতা হবে। গ্যাভি, সেপি, ডব্লিউএইচও এই প্রতিযোগিতার আশঙ্কা করেই কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, আমরা যদি চিন্তা করি এইচওয়ান এনওয়ান যেটা হয়েছিল প্যানডেমিক দশ বছর আগে। সেখানে কিন্তু আমরা ভ্যাকসিন পাইনি। কারণ সেখানে যেটা তৈরি হয়েছিল, উন্নত দেশে চলে গিয়েছিল। আমরা অনেক পরে কিছু ডোজ পেয়েছিলাম, তখন আর দরকার ছিল না। তার জন্য আমি মনে করি, যদিও অনেক চেষ্টা হচ্ছে বাংলাদেশ এই প্রতিযোগিতার মধ্যেই থাকবে। কারণ ভ্যাকসিনের উৎপাদন তো শতভাগ হবে না।
করোনার ভ্যাকসিনের জন্য অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অধীনে প্রচেষ্টা চলছে ২০২১ সালের মধ্যে দুই বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন নিশ্চিত করার। এর মধ্যে এক বিলিয়ন ডোজ বরাদ্দ থাকবে ৯২টি নিম্নআয়ের দেশের মানুষের জন্য।
এ দেশগুলোয় পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বসবাস। বাংলাদেশও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির অধীনে প্রতিটা দেশের ঝুকিপূর্ণ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত ১৫৬টি দেশ কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিতে ভ্যাকসিন সহযোগিতায় অংশীদার হয়েছে।
বাংলাদেশ চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সমীর কুমার সাহা বলেন, এখানে কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। চ্যালেঞ্জটা হলো এখানে সমতা আনাটা খুব কঠিন হবে। কারণ চীন জয়েন করেনি, আমেরিকাও জয়েন করেনি। সেইখানে আমরা আরেকটা বিপদের মধ্যে পড়ছি। নিম্নআয়ের দেশগুলো কীভাবে এটাকে ম্যানেজ করবে সেটার একটা চিন্তা এবং এর বিতরণটা কিন্তু নিম্নআয়ের দেশের জন্য আরো জটিল হয়ে যাবে।
ন্যাচারের রিপোর্টে দেখা যায়, তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে থাকা একাধিক ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটের কাছ থেকে ব্রিটেন নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য মাথাপিছু ৫ ডোজ ভ্যাকসিন অগ্রিম বুকিং দিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন জাপান অস্ট্রেলিযার মতো দেশ সম্ভাবনাময়ী ভ্যাকসিন মাথাপিছু একের অধিক ডোজ নিশ্চিত করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
এ অবস্থায় ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশ কী করছে? এমন জিজ্ঞাসা অনেকের। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, একাধিক ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশ তৎপর রয়েছে। এর জন্য অর্থ বরাদ্দও রাখা হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুল মান্নান বলেন, এখানে ট্রায়াল হবে। আরো ট্রায়ালের জন্য যোগাযোগ করেছে। তিন–চারটি আছে পাইপলাইনে। সরকার অনুমোদন দিলে হবে। সরকার বসে নেই। উই আর ট্রাইং আওয়ার বেস্ট। এদিকে যেকোনো ভ্যাকসিন প্রয়োগের আগে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ওপর তার ট্রায়াল করা জরুরি বলে মনে করছেন ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞরা।
