পর্ব-৩
মুকসুদপুর উপজেলার শেষ মাথায় কুমার নদ। পেরিয়েই পা রাখলাম তথা সাইকেল রাখলাম ফরিদপুরের সালথা উপজেলায়। সালথাকে সাথে পেলাম কিছুক্ষণ। ক্ষণেক বাদেই শুরু হলো নতুন একটা উপজেলার সীমানা। নগরকান্দা উপজেলার জমজমাট জনপদ জয় বাংলা মোড়। বড্ড অকালে ঝরে যাওয়া গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের আবক্ষ একটি ভাষ্কর্য আছে এখানে। নগরকান্দায় প্রবেশ করতেই চোখে প্রশান্তি এনে দিল বিশাল সব শিরীষ গাছ। পথিককে ছাওয়া দিতে এইসব মহিরুহ ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছে পথময়। মুনসরাবাদ থেকে শুরু ভাংগা উপজেলার সীমানা। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এই উপজেলারই সন্তান।
ভাংগা সদরের একটু আগে নুরপুরে তাঁর আবাস। তিনি চিরশায়িতও আছেন এখানে। প্রিয় এই মানুষের সমাধিটা দেখে আসার সুযোগটা হাতছাড়া করার কোন ইচ্ছেই ছিল না। ততক্ষণে মেঘকে পরাভূত করে সূর্য তার হলদে নরম আলো ছড়াতে শুরু করেছে। মহাসড়কের সাথেই তারেক মাসুদের বাড়ি। শিউলি আর বকুলের ঝরে যাওয়া ফুলে সাদা হয়ে থাকা ঢালু রাস্তায় সাইকেলের চাকা ঘুরতেই বাড়ির আঙিনায় চলে এলাম। বাড়ির উঠোনের কোণে আম গাছের ছায়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত মাটির ময়না আর আদমসুরতখ্যাত এই গুণী। কবরের চারপাশে টগর গাছ বজায় রেখেছে আপন শুভ্রতা। বাড়ির আঙিনা আরও হরেক রকমের ফুলে ভর্তি। ভাংগা গোল চত্বর থেকেই শুরু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। আমার আপাত গন্তব্য ঢাকা হওয়ায় আমি ধরলাম সোজা রাস্তা। এই অংশে এক্সপ্রেসওয়ের শুরুটা উঁচু কয়েকটা ফ্লাইওভার তথা উড়াল পুল দিয়ে। আপহিল–ডাউনহিলের খেলায় ভালোই মেতে উঠলাম। এই এক্সপ্রেসওয়ের একটাই অসুবিধা–আশেপাশের বাজার তথা জনপদের দেখা মেলে না সহজে। দেখার মতোও তেমন কিছু নেই। রাস্তার দুধারে নেই গাছও। মাঝের ডিভাইডারে জারুল, রাধাচূড়া লাগানো হলেও সেগুলো মহিরুহের পর্যায়ে যেতে বেশ সময় দরকার।
মালিগ্রাম, পুলিয়া হয়ে কিছুদূর এগিয়ে ফরিদপুর ছাড়িয়ে প্রবেশ করলাম মাদারীপুর জেলায়। উপজেলার নাম শিবচর। প্রথমেই পেরোলাম আড়িয়াল খাঁ নদী। মাখনের মতো মসৃণ রাস্তা ধরে টানা চালিয়ে সামাজিক বাজার নামক অদ্ভুত নামের বাজার। এর পরেই দারুণ জমজমাট পাঁচ্চর বাজার। আরো খানিকক্ষণ প্যাডেল ঘোরাতেই চলে এলাম আরেকটা নতুন জেলায়– শরীয়তপুর। প্রথম বড় বাজারের নাম নাওডোবা আর উপজেলার নাম জাজিরা। সামনেই পদ্মা সেতু। এই সেতুতে সাইকেল, মোটরবাইক ধাঁচের যানবাহন নিষিদ্ধ। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার আগে সাইকেল নিয়ে দাঁড়ালাম কোন খালি ট্রাক থেকে লিফট নেওয়ার আশায়। মিনিট চল্লিশেক দাঁড়িয়ে থেকেও খালি ট্রাক পেলাম না। একটা ট্রাক থামলেও নিতে রাজি হয়নি। অনেক সময় নষ্ট হওয়ায় শেষমেশ খোঁজ করার চেষ্টা করলাম মোটরসাইকেল কীভাবে পার হয় সে রহস্য উদ্ঘাটনের। বীর বাঙালিরা নিশ্চয়ই কোন উপায় বের করে রেখেছে। খানিক বাদেই দেখা পেলাম চারখানা মোটরবাইক সমেত একটা পিকাপের। আরো দুটো মোটরসাইকেল হলেই পিকাপ সেতু দিয়ে পদ্মা পার করে দেবে! আমার সাইকেলটা উঠিয়ে দিলাম। এখানেও অপেক্ষা করতে হলো বেশ কিছু সময়। শেষমেশ তেরপল দিয়ে মোটরসাইকেল ঢেকে টোল প্লাজা ছাড়িয়ে সেতুতে উঠলাম। ভালো কথা, টোল প্লাজার লোকদের চোখ ফাঁকি দিতে মোটরসাইকেল তেরপলে ঢাকা দেওয়া হলেও আরোহী যারা পিকাপের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তারা সবাই হেলমেট পরা ছিলেন! এটার সাইন্সটা বুঝলাম না!
স্বপ্নের পদ্মা সেতু পিকাপে পাড়ি দিয়ে টোল প্লাজার পরেই নেমে আবার সাইকেলের স্যাডলে। পদ্মা সেতু পারাপারের চক্করে পড়ে ঘন্টা দেড়েকের বেশি সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আজকের গন্তব্য ঢাকা অবশ্য এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ওপারের জাজিরা থেকে এসে নামলাম এপারের মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে। লৌহজং অবশ্য বেশিক্ষণ সঙ্গ দিল না। তার জায়গা নিল মুন্সিগঞ্জেরই আরেক উপজেলা শ্রীনগর। পরের পথটুকু এক্সপ্রেসওয়ের পাশের পথ ধরেই এগিয়ে চলা। ছোটোখাটো কিছু জনপদ পেরোচ্ছি। শ্রীনগরের পরে পেলাম ষোলঘর। নরম আলো বিলানো সূর্য ততক্ষণে কিছুটা তেতে উঠেছে। যদিও তাপমাত্রা সহনীয়ই আছে। নিমতলা বাজার থেকে প্রবেশ করলাম সিরাজদিখান উপজেলায়। এখানেই কাকির হোটেলে দুপুরের খাবার সেরে আবার প্যাডেলে পা রাখা। কুচিমোড়া বাজারের শেষ সীমায় ধলেশ্বরী নদী পেরিয়ে ঢুকলাম ঢাকা জেলায়। রাজেন্দ্রপুর থেকে এগিয়ে বামে মোড় নিয়ে বাবু বাজার পানে এগিয়ে চলা। শেষদিকে কিছুটা জোরেই চালিয়েছি। উদ্দেশ্যে বিকাল পাঁচটার আগেই ঢাকা শহরে ঢুকে পড়া। চারটা বেজে বিশ মিনিট নাগাদ বাবু বাজার ব্রিজের উপরেই আমাকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিল ঢাকার চিরচেনা ট্রাফিক ফাঁস। বাতাস গুণমান সূচকে উপরের সারিতে স্থান পাওয়া জীবাশ্ম–জ্বালানি পীড়িত এই শহরের নানান জায়গায় বেশকিছু সময় ট্রাফিক ফাঁসে হাঁসফাঁস করে কাটাতে হলো। পুরান ঢাকার জ্যাম ঠেলে বুয়েটের কাজী নজরুল ইসলাম হলে ঢুকি বিকাল পাঁচটার কিছু বাদে।
পরিকল্পনা করার সময় এই দিনটা নিয়ে খানিকটা পেরেশানির মধ্যেই পড়েছিলাম। ঢাকা থেকে বাহুবল কিংবা আউশকান্দির দিকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। এই পথটা মূলত মহাসড়ক ধরে। সিলেটে চাকরির সুবাদে এই পথের নিয়মিত যাত্রী হওয়ায় খুব নতুন কিছু যে দেখার মিলবে না, সেটা জানা ছিল। নতুন করে গোল বাঁধাল ছোট বোন খাতুন। ও নাকি ওই সময়ে সিলেট আসবে এবং আমাকে ওর সাথে দেখা করতেই হবে। যতই বলি না কেন আমি এই মুহূর্তে সাতক্ষীরা, সেসব ও কানেই তোলে না। ওর স্বভাববশত প্রথমেই আমাকে হত্যার হুমকি দিল! অবশ্য এমন হুমকি ও সবাইকেই দেয়। এসব হুমকি সত্যি হলে দেশের সিরিয়াল কিলিং এর ইতিহাসে এরশাদ শিকদারের বদলে খাতুনের নাম থাকত! যাই হোক, হত্যার হুমকি পাত্তা না দেওয়ায় ও এবার অন্য মারণাস্ত্র ছুঁড়ল। আমার জন্য এবার নাকি জোরেশোরে মেয়ে দেখবে আর আমার মায়ের সাথেও নাকি এ ব্যাপারে কথা বলবে। এবার ব্যাপারটা আমার জন্য মরণঘাতী হয়ে গেল! আর হালকা করে নেওয়ার সুযোগ নেই। অগত্যা বাধ্য হয়েই জানালাম আমি শ্রীমঙ্গল আসছি।
সকালে বুয়েটের হল থেকে ভোর পাঁচটার অল্প পরেই বেরিয়ে পড়লাম। সানি এত সকালেও চা বানিয়ে ফেলেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে ভোরের ঢাকার রাস্তায়। ভোরের পূতিগন্ধময় রাস্তা জোর প্যাডেলে পার করছি। সায়েদাবাদের দিকে রাস্তায় আড়াআড়ি করে রাখা বাস বারকয়েক পথ আটকাল। স্টাফ কোয়ার্টার হয়ে তারাবোর রাস্তা ধরলাম। সুলতানা কামাল সেতু পেরিয়েই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। কী কারণে জানি না সকাল থেকেই অনেকগুলো মরা ব্রয়লার মুরগি রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছি। পা দুটো ঊর্ধ্বমুখী করে মরে পড়ে আছে। সকালের ফাঁকা রাস্তায় রুপসী হয়ে ভুলতা আসতে বেশি সময় লাগল না। আড়াইহাজার উপজেলা পেরিয়ে খরিয়া থেকে ঢুকে পড়লাম নরসিংদীতে।