ভোট এ বছর না হলে সরকারের পাশে থাকা কঠিন হবে

গুলশানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সংবাদ সম্মেলন তিন উপদেষ্টাকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি

| শুক্রবার , ২৩ মে, ২০২৫ at ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ

ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচন না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন ধরে রাখা বিএনপির জন্য কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামজাতীয় স্থায়ী কমিটির সংবাদ সম্মেলনে দলের এ অবস্থান তুলে ধরেন তিনি। খন্দকার মোশাররফ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে মানুষের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকারসহ ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যত শিগগির সম্ভব জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। আমরা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। এই সর্বোচ্চ জনআকাঙ্ক্ষা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়াটাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এজেন্ডা হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। এর অন্যথা হলে হলে জনগণের দল হিসেবে বিএনপির পক্ষে এই সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ছোট করার কথাও বলেছে বিএনপি। খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, যেহেতু, একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই এই সরকারের প্রধান কাজ। তাই মাথাভারী উপদেষ্টা পরিষদ না রেখে শুধু রুটিন ওয়ার্ক পরিচালনার জন্য একটি ছোট আকারের উপদেষ্টা পরিষদ রাখাই বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের বিতর্কিত উপদেষ্টাদের (উপদেষ্টা আসিফ ও মাহফুজ) পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি।

খন্দকার মোশাররফ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব উপদেষ্টা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে সবাই জানে ও বোঝেউপদেষ্টা পরিষদে তাদের উপস্থিতি সরকারের নির্দলীয় নিরপেক্ষ পরিচিতিকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে বলেই সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার গতকালকের বক্তব্য নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাকে অব্যাহতি দিতে হবে। ফ্যাসিবাদের দোসর কয়েকজন উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি আমরা ইতিপূর্বে অনেকবার উত্থাপন করেছি।

গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির এ জরুরি সংবাদ সম্মেলন হয়। এতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কতিপয় উপদেষ্টা ও নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিতর্কিত কার্যক্রম, সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নের মুখে : খন্দকার মোশাররফ বলেন, ঐক্যের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কথা ছিল। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কোনো কোনো মহলের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাই যেন সরকারের কর্মপরিকল্পনার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বক্তব্য আমরা বারবার উচ্চারণ করেছি। অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। তাদের সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টা, যাদের বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, এমন বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়ার দাবি আমরা তুলেছিলাম। অন্তর্বর্তীকালীন অস্থায়ী সরকারের একমাত্র ম্যান্ডেট হচ্ছে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। অথচ সরকারের মুখপাত্র হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন যে, এই সরকারের সবকিছু করার ম্যান্ডেট রয়েছে।

খন্দকার মোশাররফ বলেন, মানবিক করিডোর ও চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে সরকারের বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কিনা, সেটা সবার আগে বিবেচনায় নেওয়া দরকার। এমন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘ মেয়াদি নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার অস্থায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের আছে বলে দেশের জনগণ মনে করে না।

সংস্কারবিচার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে : খন্দকার মোশাররফ বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, তাই সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া দুটোই একসঙ্গে চলতে পারে। পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি ও ব্যক্তির, অর্থাৎ দল ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ নেতা বলেন, দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার নাগালের মধ্যে রাখতে, বিনিয়োগ, ব্যবসাবাণিজ্যে গতিশীলতা আনার লক্ষ্যে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সরকার ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।

কমিশন ঘেরাও বিব্রতকর : খন্দকার মোশাররফ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি সংস্কার সনদ তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যেই একই বিষয়গুলো নিয়ে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে একটি দলের নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি আমাদেরকে এবং সরকারকে বিব্রত করে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেও একটি মহল নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন চায়। সরকার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় সব ক্ষেত্রে আমাদের মতামত না নিলেও নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে এই কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসংক্রান্ত বিষয়ে আদালতের রায় অনুযায়ী গেজেট নোটিফিকেশন করায় নির্বাচন কমিশনকে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা। এমন বাস্তবতায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করার বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক ও রহস্যজনক।

এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মোশাররফ বলেন, আমাদের সবার মতামত নিয়ে সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। এখন আমরা মনে করি, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য এটি পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে।

ইশরাকের শপথের ব্যবস্থা নিন : খন্দকার মোশাররফ বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই দেশের জনগণ রক্ত দিয়ে গণঅভ্যুত্থান করেছে। সুতরাং আমাদেরকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকতে হবে। আমরা আশা করব নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল এবং উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে শিগগিরই সরকার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে শপথ গ্রহণ করানোর ব্যবস্থা করবে।

সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সরকারের যা করণীয়, তা যথা সময়ে না করে চাপের মুখে করার সংস্কৃতি ইতোমধ্যেই সরকারের সক্ষমতা ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে এবং অন্যদেরকেও একই প্রক্রিয়ায় দাবি আদায়ের ন্যায্যতা প্রদান করেছে। এই অনভিপ্রেত ও বিব্রতকর পরিস্থিতির দায় পুরোটাই সরকারের বলে আমরা মনে করি।

আমরা অসহযোগিতা করছি না : স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, আজ এই সংবাদ সম্মেলনে আমরা অসহযোগিতার কথা বলিনি। আমরা বলেছি যে, সরকার যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যেখানে আমরা প্রথম দিন থেকে প্রকাশ্যে বলে আসছি যে সরকারকে আমরা সহযোগিতা করতে চাই, তাদেরকে যৌক্তিক সময় দিতে চাই নির্বাচন করার জন্য। আমরা এখন বলছি যে, এরকম কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে সেই সহযোগিতা করাটা কঠিন হবে।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমাদের বলা হয়েছে, আমরা ডিসেম্বরে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, জাতি চাচ্ছে, সবার প্রত্যাশা ডিসেম্বরে নির্বাচন। সেটা মাথায় রেখে একটা কেয়ারটেকার মোডের দিকে যাওয়ার কথা। কেয়ারটেকার মোডের দিকে যদি আমরা এগিয়ে যাই, তাহলে এই যে অ্যাডভাইজরি কমিটি আছে, সেটাকে কমিয়ে কেয়ারটেকার মোডে যেতে হবে। আমরা উপদেষ্টার সংখ্যা কমানোর কথা বলেছি, বাড়ানোর নয়। এখন আপনি যখন কেয়ারটেকার মোডে যাবেনসংখ্যা আমাদের জানা আছকেয়ারটেকার সরকারে উপদেষ্টার সংখ্যা ১০ জন ছিল। আর যারা যারা বিতর্কিত তাদেরকে বাদ দিয়ে আপনাকে সেদিকে যেতে হবে। এটা আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলছি, সরকারের নিরপেক্ষতার কথা বলছি। আর নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে, এটাই আমাদের মূল কথা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধথেমে থেমে বৃষ্টি, ভোগান্তি
পরবর্তী নিবন্ধদক্ষিণ জেলা বিএনপির মেয়াদোত্তীর্ণ সকল কমিটি বিলুপ্ত