বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান পরিপূর্ণ প্রতিপালনে যথাসময়ে প্রান্তিক পর্যায়ের বিভিন্ন পর্ষদ থেকে শুরু করে শহর–নগর ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন জনপ্রশাসনের একটি অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ–পরমতসহিষ্ণুতা–ইতিবাচক প্রতিযোগিতায় দেশবাসীর সমর্থনে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের বিকাশ যেকোনো সমাজের প্রণিধানযোগ্য সামাজিক–রাজনৈতিক অনুষঙ্গ। শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য নয়; জনগণের কল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিত্বের অনুসন্ধান সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। রাষ্ট্র পরিচালনায় এর ব্যতিক্রম কোনো পন্থা অবলম্বন করা হলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের স্খলন ও অবৈধ–অনৈতিক সেনা–স্বৈরশাসন উন্মেষের সুযোগ তৈরি হয়। ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও যথোপযুক্ত রীতি–নীতি অনুসরণ করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সকল কার্যক্রম সুচারুরূপে সুসম্পূর্ণ করা বিধিবদ্ধ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সাম্প্রতিককালের নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন মিথ্যাচার–কদাচার–উদ্দেশ্যপ্রণোদিত–চক্রান্ত–ষড়যন্ত্রের সংবাদে অজানা আতঙ্ক–আশঙ্কায় দেশব্যাপী নির্বাচনের প্রতি বিরূপ মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরে দেশের নির্বাচনব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের পক্ষ–বিপক্ষ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল–ব্যক্তি–সুশীল সমাজ–গণমাধ্যম সরব রয়েছে। ইতিমধ্যে বিরোধী দলগুলো আগামী ২০২৩ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম এর ব্যবহার হলে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় দলীয় সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব কটি নির্বাচনী এলাকায় ইভিএমে ভোট গ্রহণের ইঙ্গিত দেওয়ায় এ নিয়ে নতুন করে তর্ক–বিতর্কের সূচনা অধিকমাত্রায় দৃশ্যমান হচ্ছে। ইভিএমের কার্যকারিতা নিয়ে চলছে চুলছেড়া বিশ্লেষণ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৭ সালে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের কার্যকরী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতির সফল ব্যবহারের কারণে বুয়েটের আইআইসিটি বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ইভিএম তৈরি প্রকল্প তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে জমা দিলেও ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরির কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় তা বাস্তবায়িত হয়নি।
পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন পরীক্ষামূলকভাবে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ১৪টি, ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ৫৮টি এবং ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করা হয়। ২০১৮ সালের ১৫ মে খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ২৪ নম্বর এবং ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের সবকয়টি কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনে ভোট নেওয়া হয়। ২০১২ সালে কুমিল্লা ও ২০১৩ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হয়েছিল। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকার ২টি, চট্টগ্রাম–রংপুর–খুলনা–সাতক্ষীরায় ১টি করে মোট ৬টি আসনে এবং একই বছর জুনে বগুড়া–৬ আসনের উপনির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সবগুলো কেন্দ্রে ভোট হয় ইভিএমে। ঐ দুটি সিটি নির্বাচনে ১৪ হাজার ৪৩৪টি বুথে ইভিএম ব্যবহৃত হয়েছে ২৮ হাজার ৮৬৮টি।
নির্বাচন বিশ্লেষক–বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনার ক্ষেত্রে ইভিএম একটি উত্তম মাধ্যম। রাজনৈতিক মহলে ইভিএমের পক্ষে–বিপক্ষে যে আলোচনা সেটি একান্তই রাজনৈতিক। প্রকৃতপক্ষে ইভিএমে ভোট কারচুপি করার কোনো সুযোগ নেই। তবে কোথাও কেন্দ্র দখল বা বুথ দখল হলে সেই দায় ইভিএমের নয়। ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ইভিএমের ব্যবহার দেখা গেছে। উক্ত নির্বাচনে ভোটাররা ইভিএমে আগুলের ছাপ না মেলা, ভোট গ্রহণে ধীর গতি, আগেই বোতাম চেপে ভোট দিয়ে রাখাসহ বিভিন্ন অভিযোগ করলেও একজনের ভোট আর একজন দিয়েছে এমন খবর পাওয়া যায়নি। সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) শাহাদত হোসেন ব্যালট পেপারের চেয়ে ইভিএমে ভোটগ্রহণ আরও নিরাপদ ও স্বচ্ছ পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একসময় জাল ভোট হতো। কোনো কেন্দ্রে ঝটিকা আঘাত হেনে আধাঘন্টা, এক ঘন্টার জন্য কেন্দ্রটা দখল করে ২০০–৩০০ ব্যালট পেপার বাক্সে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটত। ইভিএম একটি যন্ত্র। উল্লেখ্য অনিয়মগুলো চিহ্নিত করতে ভালো একটা যন্ত্র হচ্ছে ইভিএম। কেউ যদি বলে ডিজিটাল কারচুপি করা সম্ভব, এটা সম্ভব না। যদি না মেশিনের প্রোগ্রামিং চেঞ্জ করতে পারে। সেটা নিশ্চিত সম্ভব না।’
২৫ মে ২০২২ নির্বাচন কমিশনে দেশের বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ইভিএম বিষয়ক মতবিনিময় সভায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এম কায়কোবাদ উভয়েই ইভিএম অত্যন্ত চমৎকার মেশিন এবং এখানে ম্যানিপুলেশন (কারচুপি) করার জায়গা নেই বলে মন্তব্য করেছেন। তবে একটি মেশিনকে কখনোই শতভাগ বিশ্বাস করা উচিত হবে না মর্মেও মতামত প্রদান করেন। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ইভিএম বিষয়টি পুরোটা দেখেছি। তার ভেতরে যে টেকনিক্যাল বিষয় আছে সেটাও তাঁদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছি। সর্বশেষ তাঁরা আমাদের জন্য একটি মেশিন খুলে রেখেছিলেন, যাতে ভেতরের আইসি লেভেলে দেখতে পারি, কেউ যদি এটি ম্যানিপুলেট করতে চায় কতটুকু কঠিন বা সহজ হবে সে ধারণা পাওয়ার জন্য। আমি ব্যক্তিভাবে কনভিন্সড হয়েছি। যেহেতু আমাদের বায়োমেট্রিক ডেটা আছে, সেজন্য ভোট দেওয়া অত্যন্ত নিখুঁতভাবে করা সম্ভব, একজন মানুষ অন্যজনের ভোট দেওয়া মোটামুটিভাবে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি আমাদের দেশের জন্য পারফেক্ট একটি মেশিন। অত্যন্ত সহজভাবে এটা চালানো সম্ভব।’
মে মাসের ৯ তারিখ নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার জনাব মো: আলমগীর জানান যে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা তৈরি করতে পারলে ১০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা সম্ভব। ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সক্ষমতা ইসির নেই। ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন দলের সংশয় প্রকাশকে ভিত্তিহীন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আমাদের সকলের জানা যে, ১৮৫৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি চালু হয়। ১৮৮৮ সালে ম্যাসাচুয়েটসও একই পদ্ধতি গ্রহণ করে। কালক্রমে আমেরিকার বিভিন্ন সিটি নির্বাচনে ধীরে ধীরে এর বিস্তার ঘটে। ১৯৬৫ সালে প্রবর্তিত হওয়া ‘ভোটোমেটিক সিস্টেম পাঞ্চকার্ড’, ১৯৭৪ সালে ডিআরই ভোটিং মেশিনের পেটেন্ট আবিষ্কার, ১৯৭৫ সালে ভিডিও ভোটার সিস্টেমের প্রবর্তন এবং ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ইন্টারনেট ভোটিং সিস্টেম শুরুর মাধ্যমে আস্তে আস্তে বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ভোটিং ও ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের প্রচলন হয়ে আসছে। মূলত ১৯৬০ এর দশকে পাঞ্চকার্ড দিয়ে ভোট প্রদানের রূপরেখা আবিষ্কারের প্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭টি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনে সর্বপ্রথম ইলেকট্রিক ভোটিং পদ্ধতি দৃষ্টিগোচরে আসে। ইতিপূর্বে ইভিএমের সাহায্যে ভোটাধিকার প্রয়োগে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পেরু, রোমানিয়া, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ভেনেজুয়েলা এবং ফিলিপাইন। এই উপমহাদেশে প্রথম ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ হয় ভারতের কেরালা রাজ্যে। ভারত ছাড়াও জর্ডান, মালদ্বীপ, নামিবিয়া, মিসর, ভুটান এবং নেপালে ইভিএম প্রক্রিয়ায় ভোট গণনা করা হয়।
সচেতন মহলের বিবেচনায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারি ১৯৭৩ গণভবনে সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণের নির্যাস এখনও সমধিক প্রযোজ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের সাথে আলোচনা করতে চাই যখন জানি যে ইলেকশন ৭ই মার্চ হচ্ছে। এটা আমাদের জাতির পক্ষে বড় জিনিস। এর ওপর জাতির সফলতা ব্যর্থতা নির্ভর করে।….. আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমার দেশ চলবে। এটা যে শুধু আমার কথা তা নয়। যে শাসনতন্ত্র আমরা দিয়েছি সে শাসনতন্ত্রে সেটা প্রত্যেক অক্ষরে অক্ষরে গ্রহণ করা হয়েছে।…..এটা শাসনতন্ত্রের মূলনীতি।…. যে শৃঙ্খলাকে ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র দিয়েছি যার জন্য আমরা স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছি এতো শহীদ হয়েছে, এতো রক্ত দিয়েছি এটা মিথ্যে হয়ে যাবে যদি আমরা আমাদের আদর্শ এবং মূলনীতি থেকে দূরে সরে যাই।…. এই নির্বাচন যদি শান্তিপূর্ণ হয়। এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, আপনারা করতে পারেন তাহলে দুনিয়ার কাছে আপনাদের ইজ্জত বেড়ে যাবে, যা আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি, সেটা আমরা বিশ্বাস করি তারপর আপনাদের এবং দেশের সাড়ে সাত কোটি লোকের ইজ্জত দুনিয়াতে বেড়ে যাবে।’
নির্বাচন সংক্রান্ত বঙ্গবন্ধুর অমূল্য নির্দেশনা যদি দেশবাসীর উপলব্ধির গভীরে যথার্থ প্রোথিত করা যায়; দেশের অগ্রগতির পথকে সুগম–নিষ্কণ্টক করার ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় উদ্যোগ আর কিছু হতে পারে না। প্রাসঙ্গিকতায় বর্তমান সরকারের অধীনে ইভিএম পদ্ধতিতে অবাধ–সুষ্ঠু–দলমত–ধর্ম–বর্ণ ও অঞ্চল নির্বিশেষে সংবিধান সম্মত উদ্দিষ্ট ভোটারদের যথার্থ অধিকার প্রয়োগে সকল প্রকার অর্থ–পেশি–আধিপত্যের অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একটি গ্রহণযোগ্য–প্রশ্নাতীত নির্বাচন প্রত্যাশা করা মোটেও অযৌক্তিক বা অমূলক নয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।