ভোগ্যপণ্য : ক্রেতারা অসহায়

বিশ্বজিৎ বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ৯ মার্চ, ২০২৩ at ৫:০৯ পূর্বাহ্ণ

বিকেল তখন সোয়া চারটে। মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে বাসা থেকে বেড়িয়েছিলাম। গলির মুখে ছোট্ট একটা হোটেলে বসে পঞ্চাশোর্ধ এক ব্যক্তি লাল শাক দিয়ে ভাত খাচ্ছিলেন। হাত ধোয়ার অজুহাতে আমি সে হোটেলে ঢুকলাম। নামবাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করতে বললেন আলী হোসেন, বাড়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পেশায় দিন মজুর। জিজ্ঞেস করলাম শুধু লাল শাক দিয়ে ভাত খাচ্ছেন কেন? উত্তরে আলী হোসেন বললেন, বাবা আমাদের কি আর সে সামর্থ্য আছে, প্রতিদিন মাছমাংস দিয়ে খাওয়ার। প্রতিউত্তরে বললাম: কেন আপনারদের তো আয় রোজগার বেড়েছে। আগে পাঁচশ টাকার বিপরীতে দৈনিক এখন প্রায় হাজার টাকা পাচ্ছেন। উত্তরে তিনি বললেন, পেলে কী হবে আয়ের সাথে ব্যয়ের বিস্তর ফারাক; পোষাতে পারি না।

নিজের খরচাপাতি মিটিয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। ভাবলাম কথাটা মোটেই ফেলার নয় এবং অবাস্তব কিংবা অবান্তর নয় বরং অপ্রিয় সত্য। এই অপ্রিয় সত্যটাকে মেনে নিয়েই দেশের এক তৃতীয়াংশ নাগরিক তাদের আয়ব্যয়ের হিসাব মিটিয়ে দিনাতিপাত করে চলেছেন নীরবেপ্রতিবাদহীন ভাবে। কারণ কাকে বলবেন; কেই বা শুনবেন। নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নআয়ের আহাজারী, দু:খ দুর্দশার কথা। প্রায় প্রতিদিন যেভাবে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়াচ্ছে সেসব নিয়ন্ত্রণ করার বা দেখভাল করার যেন কেউ নেই। সাধারণ নাগরিকরা এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডেকেটের কাছে প্রতিমুহর্ূতে জিম্মি। তা না হলে প্রতিদিন কেমনে কোন না কোন জিনিসের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ে? দোকানীদের একমাত্র বাক্য দাম বাড়তি। যারা সপ্তাহে কিংবা প্রতিমাসে বাজারে যান তারা আমার সাথে একমত হবেন যে কোনো কোনো নিত্যপণ্য প্রতিদিন বাড়ে আবার সকালে একদাম থাকলেও বিকেলে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। এখানে বিক্রেতাদের জবাব দেয়ার কিংবা নেয়ার যেন কোনো বালাই নেই। এতে নিম্ন আয়ের মানুষরা একেবারে অসহায়। তারা প্রতিবাদ করে কিংবা অভিযোগ করেও কোনো সমাধান পাচ্ছেন না। এসব দেখভালের যেন কোনো সংস্থা কিংবা লোকজন নেই। অনেককে বলতে শুনি অভিযোগ করে লাভ কী? প্রতিকার তো নেই। এতে স্বল্প আয়ের মানুষ পড়েছে বিপাকে। তাদের একবেলা আহার জোটে তো অন্য বেলা জোটে না। এদেশে উচ্চবিত্তমধ্যবিত্তনিম্নমধ্যবিত্তনিম্নবিত্ত এবং গরীব মানুষদের মাঝে বিস্তর ফারাক। এমুহূর্তে বিশিষ্ট কণ্ঠ শিল্পী শ্রদ্বেয় ভূপেন হাজারিকার একটা গানের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি গেয়েছিলেন ‘আমি দেখেছি অনেক গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি, তার ছায়াতে দেখেছি অনেক গৃহহীন নরনারী’। কথাটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অপ্রিয় সত্য। যারা প্রতিদিনকার নিত্যপণ্যের বাজারের খোঁজখবর রাখেন তারা নিশ্চয় আমার লেখনির সাথে একমত হবেন। প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম এখন ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। যেমন ধরুন ডিম প্রতি ডজনের দাম পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি কেজি ১০০ টাকা বাড়তি। ভরা মৌসুমেও চালের দাম বস্তা প্রতি ৩শ থেকে ৪শ টাকা বেড়েছে। এবার নুডুলস্‌ এর কথায় আসি। চট্টগ্রামে উৎপাদিত ১২প্যাকেট করা নুডুলস্‌ এর মূল্য ছিল ১০০ টাকা। যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। তাতেও আবার কারসাজি। ভেতরের প্যাকেটে প্রতিটাই অর্ধেকের চেয়েও কম। কোথায় যাবেন সাধারণ মানুষ; জীবন রক্ষাকারী প্রতিটি ওষুধের মূল্যও প্রতি পাতায় প্রকার ভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। তার ওপর সরকার নিয়ন্ত্রিত গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম তো প্রতিনিয়তই বাড়ছে। অর্থাৎ একজন সীমিত কিংবা নির্ধারিত আয়ের মানুষ পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন; যা মুখ ফোটে বলতেও পারছেন না কিংবা কারো সাথে শেয়ার করতেও লজ্জা পাচ্ছেন।

দেশে উৎপাদিত সবজির দামও নাগালের বাইরে। প্রায় প্রতিটি সবজির দাম এখন উর্ধমুখী। তবে অধিকাংশ সবজির দাম এখনও ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে রয়েছে। এসব হচ্ছে এক শ্রেণি ব্যবসায়ী নামক মুনাফাখোর এবং মধ্যস্বত্বভোগিদের কারসাজি। যারা সাধারণ নাগরিকদের পকেট কেটে রাতারাতি কোটিপতি হবার স্বপ্ন দেখে এবং হয়। রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে; কিংবা সদ্য বিদায় নেয়া করোনার দোহাই দিয়ে ব্যবসায়ীরা সাধারণ নাগরিকদের আর কত ঠকাবেন এবং রাতারাতি কোটিপতি হবেন? এসব কারসাজিসিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট দপ্তর কি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না? নাকি ব্যবসায়ীদের কাছে প্রশাসনযন্ত্র সম্পূর্ণভাবে জিম্মি। এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে যারা সাধারণ নাগরিক কিংবা খেটে খাওয়া মানুষ তাদের মনে। আশা করি নিম্নআয়ের মানুষদের কথা বিবেচনায় এনে সরকার ত্বরিত ব্যবস্থা নিবেন এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবেন। তবেই দেশের মঙ্গল হবে, নিম্নআয়ের মানুষরা উপকৃত হবেন। কারণ নিম্নআয়ের মানুষরা প্রবৃদ্ধি বোঝেন না, মূল্যস্ফীতি কী তা জানেন না কিংবা সূচক কী তা জানার কথাও না। তারা চায় দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে কোনো রকমে জীবন নির্বাহ করতে। একজন নিম্নআয়ের নাগরিকের সাথে একজন শিল্পপতির গড় আয়ের তুলনা করা মোটেই সমীচীন নয়। সমগ্র বাজার ব্যবস্থাপনায়ও একটা পরিবর্তন আনা খুবই জরুরি এ মুহূর্তে। যেহেতু এদেশে এক তৃতীয়াংশই নিম্নআয়ের কিংবা গরীর মানুষের বসবাস। সেহেতু তাদের দুঃখদুর্দশা লাঘবে সরকারকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে, যা হবে নিতান্তই সময়োপযোগী এবং বাস্তব সিদ্ধান্ত।

লেখক: সাংবাদিক এবং সংগীত শিল্পী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমদনমোহন তর্কালঙ্কার : কবি ও সমাজসংস্কারক
পরবর্তী নিবন্ধঅর্থাভাবে চিকিৎসা বঞ্চিত রোগীর জীবন বাঁচাবার তরে যুদ্ধ করি