পবিত্র রমজান মাস আসার আগেই বাজার অস্থির। বেশ কিছুদিন ধরে চাল, ডালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। মধ্যবিত্তরা সঞ্চয় ভেঙে খরচ মেটাতে পারলেও কর্মহীন মানুষ পড়েছে মহাসংকটে। রোজা শুরুর আগেভাগে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়া যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি অসাধু ব্যবসায়ীদের কৌশল। রমজান মাসে দাম বাড়ালে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় বলে তারা নানা কৌশলে রমজান শুরুর আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। সমাজের কিছু লোভী মানুষ ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে দিন দিন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে অতি সাধারণ দরিদ্র মানুষদের।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় এবং বাস্তব। একটি পরিবার কিভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায় তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে চলে অর্ধাহার, অনাহার এবং পারিবারিক অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোরী, কালোবাজারীদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা কৃষিপ্রধান দেশ হয়েও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস- পেঁয়াজ, আলু, চাল জোগান দিতে না পারার কারণের মূলে রয়েছে সংরক্ষণাগারের অভাব, পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়া, কৃষকরা সঠিক মূল্য না পাওয়া, বীজের সংকট, কৃষকদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ না দেওয়া, পর্যাপ্ত গবেষণা না হওয়া, কৃষকের জন্য প্রণোদনা না থাকা ইত্যাদি। তবে এসব সংকট মোকাবিলায় সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে- পেঁয়াজ ও চাল নিয়ে গবেষণা, নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন ও উৎপাদন বৃদ্ধি। কৃষক যাতে পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্যের ন্যায্য দাম পান, এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া কৃষকের উৎপাদন খরচকে আমলে নিয়ে সব পণ্যের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ একটি দাম নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। সরকারকে কৃষকের সব সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ প্রত্যেক জেলায় একটি করে হিমাগার স্থাপনসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে পারলে আলু, চাল, পেঁয়াজসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করি।
দ্রব্যমূল্য নাগালের মধ্যে রাখা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আসন্ন রোজায় ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ও দাম স্বাভাবিক রাখতে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে। সেই জায়গায় টিসিবিকে সক্রিয় করা জরুরি। কিন্তু গত ১ এপ্রিল দৈনিক আজাদীতে ‘টিসিবির পণ্য আজ থেকে বাড়তি দামে’ শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদে যে সব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, তা বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বদলে আরো অস্থির করতে ভূমিকা পালনের আশংকা রয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে, সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির সয়াবিন তেলের দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা এবং চিনির দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়েছে। এখন থেকে সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১০০ টাকা এবং চিনি কেজি প্রতি ৫৫ টাকায় বিক্রি হবে। টিসিবির জনসংযোগ শাখার কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। খোলা বাজারের সাথে সমন্বয় করতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রির ব্যবস্থা করার একমাত্র লক্ষ্য হলো সাশ্রয়ী মূল্যে যেন সাধারণ মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে পারে। ক্রয়ক্ষমতা নিজেদের আয়ত্তে না থাকলেও টিসিবির পণ্যই এদের ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। আর এখানে যদি মূল্যবৃদ্ধি করা হয়, তাহলে তার প্রভাব পড়বে বাজারে। ওখানে আরো বেশি দাম বৃদ্ধির সমূহ আশংকা রয়েছে।
করোনা ইতোমধ্যে আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, নিঃস্ব করে দিয়েছে অনেককে। কমবেশি সবার মধ্যেই পড়েছে তার নেতিবাচক প্রভাব। অনেকেই অর্থকষ্টে দিনযাপন করছে। তাই সাধারণ জনগণের কথা ভেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর যেন ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করা হয় এবং তা যেন সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সহনশীল মাত্রায় মূল্য নির্ধারণের জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণকারীদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নিতে হবে।