চট্টগ্রাম–মোংলা রুটে কন্টেনার জাহাজ পরিচালনার মাধ্যমে দেশের লজিস্টিক খাতের সম্ভাবনার দুয়ার খোলার সুযোগ থাকলেও শুরুতেই তা হোঁচট খেল। রপ্তানি খরচ কমানোসহ আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যে গতি আনতে চট্টগ্রাম–মোংলা রুটে কন্টেনার জাহাজ চলাচল শুরু করার সব উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। পরীক্ষামূলকভাবে দুটি ভয়েজ সম্পন্ন করার পর এই রুটে নিয়মিত কন্টেনার জাহাজ চালানোর কথা থাকলেও শুল্ক বিভাগের কারণে তা আর হয়নি।
মোংলা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এটি একটি লাভজনক বন্দর হিসেবে রয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বন্দরটিতে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল বৃদ্ধির ফলে এটির শ্রম কার্যকলাপ ও বন্দরের আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে নাব্যতা সমস্যা ও সীমিত ব্যবসায়িক সুযোগ–সুবিধার কারণে বন্দরটি তার পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারেনি। বর্তমানে বছরে ১২টি কন্টেনার জাহাজও এই বন্দরে ভিড়ে না। অর্থাৎ মাসে গড়ে একটিরও কম। ওই অঞ্চলের মাছ, হিমায়িত পণ্য ও পাটসহ বিশাল রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত খালি কন্টেনার জাহাজের চলাচল না থাকায় এসব পণ্য রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। অপরদিকে মোংলা বন্দরে কন্টেনার ভর্তি পণ্য আমদানির পরিমাণ কম। যার ফলে বছরজুড়ে খালি কন্টেনারের ঘাটতি লেগে থাকে। চট্টগ্রাম থেকে খালি কন্টেনার পরিবহনের জন্য অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয়, যার ফলে সামগ্রিক কন্টেনার খরচ বেশি হয়। এতে করে খালি কন্টেনারে পণ্য বোঝাই করার সুযোগ থেকেও খুলনা অঞ্চলের ব্যবসায়ী–শিল্পপতিরা বঞ্চিত হচ্ছেন বহুদিন ধরে।
এই বিষয়টি মাথায় নিয়ে চট্টগ্রামভিত্তিক শিপিং কোম্পানি দ্য সি গ্লোরি দেশে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম–মোংলা রুটে কন্টেনার জাহাজ পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। কোম্পানিটি চট্টগ্রাম থেকে খালি কন্টেনার জাহাজে বোঝাই করে মোংলায় নিয়ে যাবে এবং মোংলা থেকে রপ্তানি পণ্যভর্তি কন্টেনার চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসবে। চট্টগ্রাম থেকে এসব পণ্য বিশ্বের নানা দেশে রপ্তানি হবে। আমদানি–রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধি ও বৃহত্তর খুলনার অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এই রুটে কন্টেনার জাহাজ পরিচালনার ব্যাপারটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছে।
সূত্র বলেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে নেওয়া এই বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বিস্তৃত নদী নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে দেশের মোট কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের সিংহভাগ পরিচালনা করে। কিন্তু কৌশলগত অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও মোংলা বন্দর রয়ে গেছে অনেকটা ব্যবহারের বাইরে। এই দুই বন্দরের মধ্যে কার্যকর অভ্যন্তরীণ নৌপথভিত্তিক কন্টেনার পরিবহন ব্যবস্থা চালু হলে দেশের লজিস্টিক অবকাঠামোতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসতে পারে বলে সূত্রগুলো আশাবাদ ব্যক্ত করে।
কিন্তু ‘সি গ্লোরি’ ফেব্রুয়ারিতে দুই দফায় ১০০ টিইইউএস করে মোট ২০০ খালি কন্টেনার পরীক্ষামূলকভাবে চট্টগ্রাম থেকে মোংলা বন্দরে নিয়ে যাওয়ার পর রুটটি বন্ধ হয়ে গেছে। কাস্টমসের জটিলতার কারণে এই রুটে আর কন্টেনার পরিবহন সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন সি গ্লোরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহির উদ্দিন জুয়েল। তিনি বলেন, এই রুটে কন্টেনারের সংখ্যা বাড়লে আমরা বড় জাহাজ চালানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু শুল্ক বিভাগ যেসব শর্ত আরোপ করছে তাতে এই রুটে জাহাজ পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। দুই ভয়েজের পর আমরা আর জাহাজ চালাইনি, বন্ধ করে দিয়েছি। তিনি বলেন, আমাদের উদ্যোগটির লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম থেকে খালি কন্টেনার মোংলায় পৌঁছে দেওয়া এবং এরপর আন্তর্জাতিক রপ্তানির জন্য কার্গো ভর্তি কন্টেনার চট্টগ্রামে নিয়ে আসা। কিন্তু আমরা আশা নিয়ে অগ্রসর হলেও বেশিদূর যেতে পারিনি।
শিপিং বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চট্টগ্রাম–মোংলা রুটে কন্টেনার জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশের বেশ কিছু বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বাস্তবতার চোখ খুলে দিয়েছে। দেশের নদীপথে কন্টেনার পরিবহনের জন্য ভৌত অবকাঠামো যেমন বিদ্যমান, তেমনি জরুরি হয়ে পড়েছে প্রশাসনিক এবং নীতিনির্ধারণী কাঠামোর আধুনিকায়ন। উদাহরণস্বরূপ চট্টগ্রাম–পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কন্টেনার রুটে বর্তমানে নিয়মিতভাবে জাহাজ চলাচল করছে, কারণ সেখানে একটি কার্যকর প্রক্রিয়া ও কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।
তারা বলেন, এ ধরনের আন্তঃবন্দর নৌপথ ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমে যাওয়া, মোংলা বন্দরের ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি বন্দর আরো কার্যকর হওয়া, মাতারবাড়ী বন্দরের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের জন্য একটি কার্যকর মডেল তৈরি হওয়া এবং ব্যবসা–বাণিজ্যের জন্য কম খরচে বিকল্প পরিবহন মাধ্যম তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সহজীকরণ, নীতিমালার হালনাগাদ এবং আন্তঃবন্দর কন্টেনার পরিবহনের জন্য একটি মানসম্মত প্রক্রিয়া গড়ে তোলা গেলে ব্যবসা–বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।