টেকনাফের সেন্টমার্টিন সৈকতে ভেসে এলো ‘অ্যারিবদা’ বা একসঙ্গে ডিমপাড়তে আসার জন্য বিখ্যাত অলিভ রিডলি জাতের একটি মরা সামুদ্রিক কচ্ছপ। গতকাল মঙ্গলবার সকালে সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে কচ্ছপটি ভেসে আসার পর স্থানীয়রা সেটি সৈকতের মাটিতেই পুঁতে ফেলে। স্থানীয় বাসিন্দা ছিদ্দিক আহমদ জানান, সকাল ৯টার দিকে সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে কচ্ছপটি ভেসে আসে। এটি ওজনে এক মণ এর বেশি। পরে সেটি সৈকতেই মাটি চাপা দেয়া হয়।
এই কচ্ছপটি অলিভ রিডলি জাতের। সৈকতে ডিম পাড়তে আসার পথেই কচ্ছপটির মৃত্যু হতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সায়ীদ মোহাম্মদ শরীফ। তিনি বলেন, ছবি দেখে মনে হচ্ছে কাছিমটি কয়েক ঘন্টা আগেই মারা গেছে। হয়ত জেলেদের জালে আটকা পড়ে মারা যেতে পারে। এর আগে গত ২৭ আগস্ট কক্সবাজারের সমিতিপাড়া পয়েন্ট সৈকতে একই জাতের মরা কাছিম ভেসে আসে বলে জানান কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের বীচকর্মী মাহবুব আলম। এছাড়া গত জানুয়ারিতে একটি কাছিম সুগন্ধা পয়েন্টে এসে ডিম পেড়ে যায় বলে জানান তিনি।
একসময় কক্সবাজার সৈকতে শত শত অলিভ রিডলি কাছিম ‘অ্যারিবদা’ বা একসঙ্গে ডিম পাড়ার জন্য আসতো। কিন্তু সাম্প্রতিককালে কক্সবাজার সৈকতে ডিম পাড়ার ঘটনা ব্যাপক হারে কমে গেছে বলে মনে করছেন প্রকৃতি সংরক্ষণকর্মীরা।
কক্সবাজার সৈকতে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাছিম সংরক্ষণে কাজ করছে বেসরকারী সংস্থা নেচার কনজোর্ভেশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট (নেকম)। সংস্থাটির আঞ্চলিক পরিচালক ড. মোহাম্মদ শফিক এর মতে, মাত্র এক দশক আগেও সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত কক্সবাজার উপকূলের অন্তত ৫৪টি পয়েন্টে শীত মৌসুমে ডিম পাড়তে আসতো শত শত মা কচ্ছপ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অন্তত ১৩টি পয়েন্টে কচ্ছপের দেখা মিলছে না। বাকী পয়েন্টগুলোতেও ডিম পাড়ছে খুব কম। তবে গত মৌসুমে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
সারা বিশ্বের সাগরে প্রায় সাত প্রজাতির সী–টার্টল বা সামুদ্রিক কচ্ছপ সাঁতার কেটে বেড়ায়। তবে আমাদের বঙ্গোপসাগরে রেকর্ড রয়েছে পাঁচ প্রজাতির। এরমধ্যে কক্সবাজার সৈকতে অলিভ টার্টল বা জলপাই রঙা কাছিম, গ্রীন টার্টল বা সবুজ রঙা কাছিম এবং হক্সবিল বা ভূত কাছিম ডিম পাড়তে আসতো। ড. মোহাম্মদ শফিক জানান, জলপাই রঙা রিডলি কাছিম কক্সবাজার সৈকতে এবং সবুজ রঙা কাছিম ও ভুত কাছিম সেন্টমার্টিনেই বেশি দেখা যেত। তবে মাঝেমধ্যে হিমছড়ি ও পেঁচারদ্বীপেও সবুজ রঙা কাছিমের দেখা মিলেছে বলে জানান তিনি। তার মতে, এক দশক আগেও কক্সবাজার উপকূলে ডিম পাড়তে আসা তিন প্রজাতির কাছিমের মধ্যে ৯৯% ভাগই ছিল অলিভ রিডলি টার্টল বা জলপাই রঙা কাছিম। বাকী একভাগ ছিল গ্রীণ টার্টল (সবুজ রঙা কাছিম) ও হক্সবিল টার্টল (ভূত কাছিম)। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেবল এক প্রজাতির কাছিমই কক্সবাজার সৈকতে ডিম পাড়তে আসছে বলে জানান তিনি।
একটি স্বাস্থ্যকর সমুদ্রের প্রয়োজনীয় অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত সী–টার্টল বা সামুদ্রিক কচ্ছপ। এটি পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংগ বা ‘কী–স্টোন প্রজাতি’ হিসাবেও বিবেচিত। পরিবেশে এই ধরনের প্রজাতির বেঁচে থাকার উপর নির্ভর করে আরো বহু প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব। কাছিমকে ‘সামুদ্রিক ঝাড়ুদার’ও বলা হয়। এরা সমুদ্রের পচা–গলা বস্তু খেয়ে দূষণ পরিস্কার করে।
সামুদ্রিক কচ্ছপ পানির বাইরেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এরা স্থলে ও সমুদ্রে একটি খাদ্য জালের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে কাজ করে। এরা সৈকতের বালিয়াড়িতে বাসা বেঁধে ডিম পাড়ার মাধ্যমে সৈকতকেও পরিবেশগতভাবে সাহায্য করে। সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিমের খোসা মাটিতে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সরবরাহ করে, যা টিলা বা বালিয়াড়ির গাছপালা ও অন্যান্য উদ্ভিদকে পুষ্ট করে। আর এর মাধ্যমে বালিয়াড়িকে স্থিতিশীল করে, উপকূলীয় ক্ষয়রোধ করতে সহায়তা করে এবং সাগরতীরের জৈব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।