ভেলুয়া সুন্দরী ও আমির সওদাগরের অমর প্রেমকাহিনি

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন | শুক্রবার , ১ আগস্ট, ২০২৫ at ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ

একটা জাতি বা সমাজের সার্বিক জীবনধারার বিচিত্র প্রকাশই সংস্কৃতি। আর এই সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি লোকজ জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি নিখুঁত চিত্র। যাতে জীবনের হাসিকান্না, গৌরব গাথা ও সুখদুঃখের বিচিত্র প্রকাশ পায় সাহিত্য হিসেবে। যাকে আমরা লোকসাহিত্য বলি।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে লোকের মুখে মুখে প্রচলিত কাহিনি, গান, ছড়া ইত্যাদিকে লোকসাহিত্য বলা হয়। লোকসাহিত্য কোনো ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি নয়, সমাজের সাধারণ মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রতীক এটি। জগৎ ও জীবন থেকে সৃষ্ট এ সাহিত্য ক্রমান্বয়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরে নতুন নতুন রূপ লাভ করে। বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতায় এটি বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।

লোকসাহিত্য প্রাচীন সমাজের এক ধরনের চাক্ষুষ বা মৌখিক সাহিত্য। লোকসাহিত্য মানুষের জীবন, বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে একটি গল্প, গান বা কবিতার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।

কাহিনি ও গল্প হচ্ছে মূলত লোকসাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে একটি। প্রতিটা মানুষের জীবন, বিশ্বাস এবং কল্পনার ওপর ভিত্তি করে এসব গল্প তৈরি করা হয়। আর এগুলো মূলত মানুষের চাহিদাকে মৌখিকভাবে প্রচার করে থাকে এবং এর পাশাপাশি মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকে। লোককথা বা মিথ হলো এই ধরনের গল্পের অন্যতম উদাহরণ। এগুলো প্রায়শই অলৌকিক বা ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে তৈরি হয় এবং মানুষকে সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা দেয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসাহিত্যের মতো চট্টগ্রাম অঞ্চলেরও রয়েছে শক্তিশালী লোকসাহিত্যের ধারা। এসব ধারার মধ্যে চট্টগ্রামের পালাগানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটা চট্টগ্রামের প্রাচীন একটি ধারা। এ অঞ্চলের পালাশিল্পীরা ওই সময়ে পালাগান গেয়ে মানুষের মনোরঞ্জনের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। এ পালাগান সাধারণত কোনো মাজারের ওরশে, বিবাহ অনুষ্ঠানে, ঋতুভিত্তিক অনুষ্ঠানসমূহে দেখা যেত। শীত মৌসুমে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পালাগান অনুষ্ঠিত হতো বেশি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের পালাশিল্পীরা তখন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পালাগান গাইতেন। চট্টগ্রামের পালাগানগুলো প্রায় সবগুলো সংগৃহীত ও প্রকাশিত হয়েছে। এসব পালাগানের বেশিরভাগ প্রেমবিচ্ছেদমূলক হলেও এগুলো ময়মনসিংহ গীতিকার মতো নারীপ্রধান নয়। চট্টগ্রামের পালাগানগুলো অধিকাংশই পুরুষপ্রধান এবং বহু সংগ্রামের মাধ্যমে নায়ক নায়িকাকে উদ্ধারের কাহিনিই বিধৃত হয়েছে। চট্টগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় পালাগান হচ্ছে ‘ভেলুয়া সুন্দরী’র পালা। আমির সওদাগর ও ভেলুয়ার কাহিনি নিয়ে গড়ে ওঠা এই পালা একসময় চট্টগ্রামে বেশ জনপ্রিয় ছিল। এই পালাটি একসময় চট্টগ্রামের বিবাহ অনুষ্ঠানগুলোতে গাওয়া হতো। এই পালাগানের অনেকগুলো মুদ্রিত সংস্করণ রয়েছে।

কিংবদন্তি লোকগীতি সংগ্রাহক ও কবি আশুতোষ চৌধুরী এই পালাগানটি চট্টগ্রামের কয়েকজন পালাশিল্পীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন রাউজানের বাগোয়ান গ্রামের জেবল হোসেন, লাম্বুরহাটের ইসমাইল এবং রাঙ্গুনিয়া থানার পোমরা গ্রামের ওমর বৈদ্য। বিশেষত ওমর বৈদ্যের নিকট থেকেই তিনি ভেলুয়ার পালাটি সংগ্রহ করেছিলেন। এই পালাগানটি আমির সওদাগর এবং ভেলুয়াকে নিয়ে রচিত হলেও এর পেছনে ছিল বিশেষ প্রেক্ষাপট। এ পালার ঘটনাসমূহে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গার নাম উল্লেখ রয়েছে, যে জায়গাগুলো বর্তমানেও পরিলক্ষিত হয়। পালায় উল্লেখিত শাপলাপুর বর্তমানে মহেশখালীর অন্তর্ভুক্ত শাপলাপুর নামেই আছে। মহেশখালীর শাপলাপুর আর ভেলুয়ার পালার শাপলাপুর এক ও অভিন্ন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মধ্যযুগের পর চট্টগ্রামে পর্তুগিজদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছিল। এ সময় পর্তুগিজরা ব্যবসায়িক কারণে শাপলাপুরে একটি বন্দর স্থাপন করেছিল। শাপলাপুর বন্দরটি ওই সময় বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। পালায় উল্লেখিত ভেলুয়ার পিত্রালয় তৈলন্যাপুর হচ্ছে বর্তমান আনোয়ারা থানার শঙ্খ নদীর তীরস্থ তৈলারদ্বীপ। এই পালার ভিলেন ভোলা সওদাগরের বাড়ি ছিল কাট্টলী গ্রামে।

পাহাড়তলী স্টেশনের নিকটে ভেলুয়ার দিঘি বর্তমানেও রয়েছে। বর্তমান চট্টগ্রাম শহরের খুলশীর পশ্চিমে কাট্টলীর অবস্থান। ভেলুয়া পালাগানের সারেঙ্গ বাদক টোনাবারুইয়ের বাড়ি বর্তমান রাঙ্গুনিয়া থানার সৈয়দ নগর। সেখানে টোনা বারুইয়ের ভিটা এখনো বর্তমান আছে। চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার সরাইপাড়া নামক স্থানে পালায় বর্ণিত মুনাপ কাজীর কাছারিঘর ছিল। সরাইপাড়ার পার্শ্ববর্তী এলাকা এখনও কাজীপাড়া নামে খ্যাত। এখানে মুনাপ কাজীর নামে দিঘিও আছে। কুড়াল্যামুড়া নামক পাহাড়টি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত। তৎকালীন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ছিল কুড়াল্যামুড়া পাহাড়। কুড়াল্যামুড়া পাহাড়ের উত্তরপূর্বে কর্ণফুলী নদীর পানির ভয়াবহ ঘূর্ণিপাক ছিল, যা কাউখালী ঘূর্ণিপাক নামে বেশ পরিচিত ছিল। ভেলুয়ার পালার আমির সওদাগর এই কাউখালী ঘূর্ণিপাকেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন বলে একাধিক প্রমাণ পাওয়া যায়। ভেলুয়ার পালায় বর্ণিত শ্রীমাই, শঙ্খ, বাইচা ইত্যাদি নদী চট্টগ্রামে বেশ পরিচিত। ভেলুয়ার কাহিনিতে আমির সওদাগর ও ভোলা সওদাগরের মধ্যে যে যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, তার বিবরণ আছে চট্টগ্রামের ইতিহাস রচয়িতা খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খাঁর ‘তারিখ ই হামিদি’ নামে ফারসি গ্রন্থে।

ভেলুয়া সুন্দরীর আখ্যান নিয়ে রচিত হয়েছে একাধিক পুঁথি। এসবের মধ্যে পালাকার মুন্সি মোয়াজ্জম আলীর লেখা ভেলুয়া সুন্দরী পুঁথি সারা দেশে জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার হামিদিয়া প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এই পুঁথি। অসাধারণ ব্যঞ্জনাময় ভাষায় লেখা সেই পুঁথি একালের পাঠককেও মুগ্ধ করবে। অপরূপা ভেলুয়া দেখতে কেমন ছিল তাঁর হৃদয়গ্রাহী বিবরণ পাওয়া যায় মুন্সি মোয়াজ্জম আলীর পুঁথিতে। ভেলুয়ার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আকাশের চন্দ্র যেন রে ভেলুয়া সুন্দরী/ দূর থাকি লাগে যেন ইন্দ্রকূপের পরি/ আর সুন্দর লাগে রে ভেলুয়ার চক্ষের ভঙ্গিমা/ আঁখির ওপর ভুরু কন্যার অতি মনোহর/ পদ্মফুলের মাঝে রে যেমন রসিক ভ্রমর।/ সারি সারি দন্তগুলি যেন মুক্তার বাহার/ হাসির বিজলি চটকের অতি চমৎকার।’

ভেলুয়ার সৌন্দর্যের ঝলকে অন্ধ আর দিওয়ানা হওয়া যেকোনো কঠিন হৃদয়ের পুরুষেরও নিয়তি। মহেশখালীর শাপলাপুরের মানিক সওদাগরের একমাত্র ছেলে আমির সওদাগরেরও সেই দশা হয়েছিল। আমির সওদাগর তৈলন্যা নগরের পাহাড়ে এসেছিল শিকার করতে। নদীর ধারের সেই রাজ্যের রাজা মনুহর আর ময়না সুন্দরীর একমাত্র কন্যা ভেলুয়া। ঘটনাচক্রে ১২ বছর বয়সী ভেলুয়ার প্রিয় কবুতরটিকে তির নিক্ষেপে হত্যা করে আমির সওদাগর। ক্ষুব্ধ ভেলুয়ার সাত ভাই তাকে বেঁধে নিয়ে আসে ভেলুয়ার কাছে। আর তখনই আমির সওদাগর ভেলুয়ার রূপে দিশা হারায়। আমিরের মনের অবস্থা কেমন, তার বিবরণ মেলে মুন্সি মোয়াজ্জম আলীর পুঁথিতে।

নানা ঘটনার পর অবশেষে ভেলুয়ার মন পায় আমির। বিয়েও হয় তাদের। ভেলুয়াকে নিয়ে আমির চলে যায় শাপলাপুরে। বিয়ের পর ভেলুয়াকে রেখে বাণিজ্যযাত্রায় বেরিয়ে পড়ে আমির সওদাগর। তবে বাণিজ্যের জন্য যাত্রা করেও আমিরের পিছুটান কাটে না। অনেকটা পথ ভুল করেই তার তরি নিজের ঘাটে এসে ভেড়ে আবার। গভীর রাতে নিদ্রিত ভেলুয়ার কাছে সে যায় সবার অজান্তে। ভেলুয়া ভাবে, বুঝি স্বপ্নই দেখছে সে। স্বামী তার ফিরে এসেছে স্বপ্নের মধ্যে। প্রেমের জোয়ারে ভেলুয়াকে ভাসিয়ে তাকে আবার নিদ্রিত রেখে সওদাগর বেরিয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে ভেলুয়ার ঘরের দরজা খোলা দেখে আমির সওদাগরের বোন ও মা ভেলুয়ার প্রতি অবিশ্বাসী হওয়ার অভিযোগ আনে। রাতের স্বপ্ন যে সত্যি ছিল, তা ভেলুয়া জানত না। প্রহেলিকায় পড়ে যায় সে। যত্নে গড়ে তোলা প্রেমের পবিত্রতা বুঝি খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে।

নিজেকে অসতী আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী ভাবতে শুরু করে ভেলুয়া। একদিন কলসি হাতে জল আনতে নদীতে গেলে কাট্টলীর সওদাগর ভোলার নজরে পড়ে যায় সে। আমিরের মতোই ভোলা সওদাগর প্রেমে অন্ধ হয়ে যায় প্রথম সাক্ষাতেই। নদীর ঘাট থেকে ভেলুয়াকে অপহরণ করে ভোলা নিয়ে যায় তার কাট্টলীর বাড়িতে। সেখানে সে ভেলুয়াকে বোঝায়, তার স্বামী আমির সওদাগর মারা গেছে। কোনো উপায় না দেখে ভেলুয়া ভোলা সওদাগরের কাছ থেকে ছয় মাসের সময় নেয়। তার বিশ্বাস ছিল যে, এই ছয় মাসেই হয়তো স্বামী ফিরবে। স্বামীর শোকেতাপে আর অপেক্ষায় ভেলুয়া রোগশয্যা নেয়।

এর মধ্যে শাপলাপুরে আমির ফিরে এসে ভেলুয়াকে দেখতে না পেয়ে বিবাগি হয়। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। টোনা বারুই নামের এক বাউলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে গানবাজনায় মনোনিবেশ করে। তবে এর মধ্যে একসময় শুনতে পায়, কাট্টলী নগরের ভোলা সওদাগরের বাড়িতেই আছে তার প্রেয়সী ভেলুয়া।

এরপর সৈন্যসামন্ত নিয়ে ভোলা সওদাগরের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় আমির। রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধে ভোলার মৃত্যু হয় আর আমির ফিরে পায় তার স্ত্রী ভেলুয়াকে। তবে ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রোগজর্জর ভেলুয়াকে নিয়ে শাপলাপুরে ফিরে আসে আমির সওদাগর। লোককথায় এই দৃশ্যের বিবরণ তুলে ধরতে গিয়ে কবি পদ রচনা করেছেন এভাবে :

বন্দরে লোকজন দেখে খাড়া হই/ ঘাটে আইল চৌদ্দ ডিঙ্গা মরা কন্যা লই।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানোন্নত হেফজখানা না হলে সহি শুদ্ধ কুরআন শিক্ষা অসম্পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রগতিশীল শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন