ভেবে দেখা হবে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা

নগরের কয়েকটি খাল পরিদর্শনে তিন উপদেষ্টা সার্কিট হাউসে আজ বৈটক প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জন্য আসছে কর্ম পরিকল্পনা ও টার্গেট

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ

আগামী বর্ষায় নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যার দৃশ্যমান উন্নতির লক্ষ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জন্য কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে দেওয়া হবে। এজন্য মার্চ মাস পর্যন্ত একটি টার্গেটও নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হলে দায় নিতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে।

আজ রোববার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠেয় নগরের জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশনায় গঠিত উচ্চ পর্যায়ের টিমের বৈঠক থেকে পরিকল্পনা ও টার্গেট ঠিক করে দেওয়া হবে। টিমের তিন সদস্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিষযক উপদেষ্টা ফারুকআজম গতকাল নগরের কয়েকটি খাল পরিদর্শন শেষে তাদের পরিকল্পনার কথা জানান সংবাদিকদের। এ সময় মানুষের কাজে না এলে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখা হবে কিনা সেটা নিয়ে সরকার নতুন করে ভাববে বলে ইঙ্গিত দেন তারা।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম, জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদসহ সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, ওয়াসা, চট্টগ্রাম বন্দর, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

সার্কিট হাউজ থেকে যাত্রা শুরু করে উপদেষ্টারা বিকাল ৩টা ৭ মিনিটে লাভলেইনে জামালখান খাল পরিদর্শনে আসেন। এ সময় মেগা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ খালের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। তিনি ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতার কথা বললে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জেলা প্রশাসককে ভূমি অধিগ্রহণে কী সমস্যা আছে তা সমাধানের নির্দেশনা দেন। এরপর মির্র্জা খাল, বারইপাড়া খাল, রাজাখাল খাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন উপদেষ্টারা।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে আমরা তিন জন উপদেষ্টা চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতার ব্যাপারে কী করা যায় এবং আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে কী করা যায় সেটা দেখার জন্য এসেছি; যাতে একটা দৃশ্যমান উন্নতি হয়। কারণ এই ধরনের প্রকল্প (জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান প্রকল্প), আমি জানি না এটা কত বছর ধরে শুরু হয়েছে। এ সময় সিটি মেয়র পাশ থেকে ২০১৬ সালে প্রথম প্রকল্প নেওয়া হয়েছে জানালে উপদেষ্টা বলেন, ১১ বছর চলছে। এত বছর হয়ে গেছে। তাই সমাধান হয়ে যাওয়া উচিত ছিল।

তিনি বলেন, এটা (জলাবদ্ধতা) তো মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ। এটা কিন্তু প্রাকৃতিক বন্যা না। নগরবাসী খাল ভরাট করে বিল্ডিং (ভবন) তুলেছেন, খালকে ময়লা ফেলার জায়গা করছেন। কেউ তো আবার নিজে নিজে ভবন তুলতে পারে না। নগর প্রশাসন, জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের সবার নীরব অথবা সরব সম্মতি নিয়ে এটা করা হয়েছে। এজন্য কাজটা বেশ কঠিন হয়ে গেছে।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এখানে অনেকগুলো মামলা (ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত) আছে। আমরা মামলার তালিকাগুলো নেব এবং মামলার বিষয়ে কী করা যায় সেটা দেখব। প্রতিবন্ধকতাগুলো দেখব। জমি অধিগ্রহণের কিছু ব্যাপার আছে, সেটাও আমরা দেখব। কোথায় জমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন সে বিষয়ে আমরা বিভাগীয় কমিশন এবং জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করব।

তিনি বলেন, কাল (আজ) সার্কিট হাউজে সবার সঙ্গে বসব। সেখানে আমরা কর্মপরিকল্পনা স্থির করব। কর্মপরিকল্পনা সংস্থাগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হবে। অন্যবারের উদ্যোগের সঙ্গে এবারের উদ্যোগের প্রার্থক্য হবে; যারা পূরণ করতে ব্যর্থ হবেন যে সংস্থাই হোক না কেন, তাদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে। মানে এটা হয় নাই, আরও এত বছর লাগবে, এত কিছু লাগবে, অজুহাত কিন্তু শোনা হবে না। তাদেরকে এটার দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করতে হবে এবং ব্যর্থতার যে দায়দায়িত্ব সেটার খেসারত তাদের দিতে হবে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয় প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে ফাওজুল কবির খান বলেন, সমন্বয় হবে। এজন্য দেখছেন আমাদের সঙ্গে মেয়র, সিডিএ চেয়ারম্যান, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বন্দরসহ সব সংস্থার লোকজন আছে। সবাইকে নিয়ে করছি। এটা (জলাবদ্ধতা) এককভাবে কেউ সমাধান করতে পারবে না। সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন, সরকারিবেসরকারি সবার উদ্যোগকে আমরা একসঙ্গে করতে চাই।

তিনি বলেন, আগামী বর্ষায় জলাবদ্ধতা শেষ হয়ে যাবে, তা না। কিন্তু একটা দৃশ্যমান উন্নতি আমরা দেখতে চাই। না হলে এসব প্রকল্প আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা ভেবে দেখব।

প্রকল্প বহির্ভূত খালগুলোকে প্রকল্পভুক্ত করা হবে কিনা জানতে চাইলে বলেন, আরো খাল আছে। সেগুলোর বিষয়ে অগ্রসর হতে আমরা আগ্রহী। কিন্তু কথা হচ্ছে, আগের কাজের হিসাব নিতে হবে। আগেরগুলো ফলপ্রসূ হয়েছে কিনা দেখতে হবে। না হলে এটা বাদ দিয়ে খালি খনন করে যাব, প্রকল্প করে যাব, ওয়াল বানিয়ে যাবএটা তো কাজের কথা হয় না। ওই জন্য আমরা দেখব মার্চের মধ্যে উনাদের যে টার্গেট দেব সে টার্গেট উনারা কতটা অর্জন করেন। অর্জন করতে না পারলে ওটার গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা আছে কিনা দেখব। এবার কিন্তু দায় নিতে হবে। দায় থেকে কেউ রেহাই পাবেন না। যে সংস্থারই হোক না কেন এ দায়ের জন্য খেসারত দিতে হবে।

বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্রকল্পগুলোর সমন্বয়ে একটা বড় ব্যাপার আছে। তাই সবগুলো সংস্থাকে নিয়ে আগামীকাল (আজ) আমরা বসব। আমরা বুঝবার চেষ্টা করব এই প্রকল্পগুলো থেকে এই বর্ষায় এবং পরের বর্ষায় কী সুফল পাব। জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের সমস্যা, একদিনে সমাধান হওয়ার নয়। কিন্তু সমাধান তো হতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে এই বছর কী হবে, পরের বছর কী হবে এবং তার পরের বছর কী হবে। প্রকল্পটা যদি দেখি মানুষের কাজে লাগছে তাহলে অব্যাহত থাকবে, যদি দেখি কাজে লাগছে না তাহলে আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে।

তিনি বলেন, খালগুলো ভরাটের তিনটি বড় বড় পয়েন্ট। একটি হচ্ছে ভূমি অফিসের সঙ্গে যোগসাজশে খালগুলো ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়ে গেছে, সেখানে বড় বড়, আট তলাছয় তলা ভবন উঠে গেছে। যে তিনটি স্পটে গেলাম সেখানে দেখেছি কিছু কিছু ভবনের কিছু কিছু অংশ ভাঙতে হয়েছে।

খাল ভরাটের দ্বিতীয় সমস্যা হিসেবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, খালের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাহাড় কাটার ফলে মাটিগুলো এসে খালে পড়ছে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে প্রচুর পলিথিন এবং প্লাস্টিক। তিনটাই জটিল সমস্যা। তিনি বলেন, পলিথিন ও প্লাস্টিকে খাল ভরাট হয় কেন? কারণ আমি আর আপনি ওগুলো ব্যবহার করি। আমিআপনি যদি ব্যবহার করা বন্ধ করে দিই তাহলে আর খাল ভরাট হবে না। প্লাস্টিক ও পলিথিন বন্ধে সচেতনতা গড়ে তোলেন। যেন এগুলো আর কেউ ব্যবহার না করে। বিকল্প কি এই প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই বাংলাদেশে। আমাদের বাবাদাদারা যেভাবে বাজার করেছে আমরা সেভাবেই করব। এটাই বিকল্প।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিষযক উপদেষ্টা ফারুকআজম বলেন, সংস্থাসমূহ যে সমস্ত কাজ করছে তার প্রতিবন্ধকতা কী আমরা পরিদর্শন করতে এসেছি। সেগুলো সরেজমিনে দেখছি, পরিমাপ করে দেখছি এবং কালকে (আজ) তাদের কাছ থেকে আরো বিশদ জানব। চট্টগ্রাম নগরে বসবাসকারী এই ব্যাপারে যারা অভিজ্ঞ আছেন, দীর্ঘ সময় নিয়ে কাজ করছেন তাদের সঙ্গেও বসব। নগর পরিকল্পনাবিদ ইত্যাদি যারা আছেন সবার সঙ্গে বসব। তাদের কাছ থেকেও সহযাগিতা নেব।

তিনি বলেন, এই নগরে যারা বসবাস করেন তারাও জলাবদ্ধতার জন্য কম দায়ী না। যত্রতত্র ময়লাআবর্জনা ইত্যাদি কিছু ফেলে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি। এতে আমাদের শহরটা আরো সুন্দর হবে।

সিডিএর প্রকল্পের কাজ শেষে সিটি কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কর্পোরেশনকে কতটা প্রস্তত করা হয়েছে জানতে চাইলে ফারুকআজম বলেন, এটা একটা নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। আমরা আগে প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তিত এবং ভাবছি। আগামী বর্ষা পর্যন্ত কতটুকু পরিত্রাণ দেওয়া যায়। এখানে স্টেক হোল্ডার ও প্রতিষ্ঠানগুলো আছে। প্রয়োজনীয় সমন্বয়গুলো আমরা অবশ্যই করব। সেই সাথে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে চাই, যাতে নগরটাকে সবাই নিজের মধ্যে ধারণ করে। এটা মেয়রের, সিডিএর শহর ; এভাবে যেন না ভাবি। এটা সবার শহর।

সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, এ শহর সবার। কাজেই শহরটাকে বাসযোগ্য করার জন্য, একটা ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটি করার জন্য সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। যেসব সংস্থা আছে সবাইকে নিয়ে একসাথে কাজ করতে হবে। তবেই চট্টগ্রাম সুন্দর শহরে পরিণত করতে হবে। তিনি বলেন, আগের সরকার মেগা প্রকল্পের নামে মেগা দুর্নীতি করেছে। আমরা এখন সততা ও একনিষ্ঠতার সাথে কাজগুলো করতে চাচ্ছি, সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে চাচ্ছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেপরোয়া ট্রাকের ধাক্কা, তিন মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধতত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে রিভিউ শুনানি আজকের কার্যতালিকায়