ভেজাল ও চোরাই বিটুমিনে সড়ক সংস্কার!

উঠে যাচ্ছে একটু বৃষ্টিতেই ম আর্থিক ক্ষতি হাজার কোটি টাকার মানহীন বিটুমিন তৈরিতে রয়েছে ১৯টি সিন্ডিকেট

| বৃহস্পতিবার , ১৭ আগস্ট, ২০২৩ at ৭:০৭ পূর্বাহ্ণ

ভেজাল ও চোরাই বিটুমিন দিয়ে সড়ক সংস্কারের কারণে একটু বৃষ্টিতেই উঠে যাচ্ছে তা। নিম্নমানের বিটুমিন দিয়ে নির্মাণ করায় সড়কের এই বেহাল দশা। আর সেই সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বাড়ছে লাশের সংখ্যা। এছাড়াও প্রতিবছর আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়কে বিটুমিন যে পরিমাণ ব্যবহার করার কথা, তা করা হয় না। প্রতি কিলোমিটারে ১৭০ ড্রাম ব্যবহার করার কথা থাকলেও ব্যবহৃত হয় ১১০ ড্রাম। সেটুকুও আবার মানহীন। বিদেশ থেকে ভেজাল বিটুমিন আসছে। এর পাশাপাশি পোড়া মবিল, কেরোসিন মিশিয়ে এটা হাল্কা করে গুণাগুণ নষ্ট করা হয়। ফলে বৃষ্টির পানিতেই বিটুমিন উঠে যাচ্ছে। তিনি বলেন, কেউ একটা বিষয় মাথায় রাখছে না যে সড়কের দুর্ভোগ সবার ওপরেই পড়ে, সে ধনী হোক বা গরিব। সড়কের বেহাল দশার পাশাপাশি নিম্নমানের বিটুমিনে দেশের আরও নানামুখী ক্ষতি হয়। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। আর এসব সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ, হচ্ছে সম্পদ বিনষ্ট ও আর্থিক ক্ষতি।

রাষ্ট্রীয় তিনটি পেট্রোলিয়াম কোম্পানির (পদ্মা, মেঘনা, যমুনা) ১৮ হাজার লিটারের বিটুমিনবাহী ট্যাংক গাড়িগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বের হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে গমন করে। যাতায়াতের পথ হিসেবে গাড়িগুলো আউটার রিং রোডকে ব্যবহার করে আসছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আউটার রিং রোডে গড়ে উঠেছে বিটুমিন চুরির একটি সিন্ডিকেট। অনুসন্ধানে জানা যায়, চার থেকে পাঁচ বছর ধরে বিটুমিন চোরাকারবারীদের এই সিন্ডিকেটটি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার গাড়ি থেকে কম দামে তেল চুরির পর কম দামে কেনা তেল বেশি দামে বিক্রি করে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে বিটুমিনের ব্যবসা করে আসছে।

নিম্নমানের ও ভেজাল মিশ্রিত বিটুমিনের বাজার তৈরি ও নিয়ন্ত্রণে এ ধরনের ১৯টি সিন্ডিকেট রয়েছে। ‘বিটুমিন সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিত এসর সিন্ডিকেট বিদেশ থেকে আবর্জনাতুল্য বিটুমিন আমদানি করে। আর দেশে আসার পর অধিক মুনাফার জন্য সেগুলোতে মেশানো হয় ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ বিটুমিনের প্রয়োজন হয়। তবে এর মাত্র ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় দেশেই; প্রায় পুরোটাই উৎপাদন করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)। বিটুমিনের বাড়তি চাহিদা মেটাতে বাকি অংশ আমদানি করা হয় দেশের বাইরে থেকে। চাহিদা ও দেশীয় উৎপাদনের এই বৈষম্যকেই কাজ লাগাচ্ছে বিটুমিন সিন্ডিকেট। আমদানি করেই ক্ষান্ত হয় না সিন্ডিকেট বরং আমদানির পরেও চলে ভেজাল মেশানোর ‘মিশন’।

র‌্যাবের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সীতাকুন্ড থেকে বারৈয়ারহাট এলাকায় ৮ থেকে ১০টি সিন্ডিকেট মিলে বিটুমিনের ড্রামে ভেজাল মেশানোর কাজের সঙ্গে জড়িত। ফেনী থেকে মীরসরাইতে কয়েকটি স্থানে বিটুমিনে ভেজাল মেশানো হয় প্রকাশ্যে। এসব মিলে বিটুমিনের সঙ্গে মাটি, বালু মিশিয়ে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। আর এই সবকিছুই হয় ‘সিন্ডিকেট’ এর নিয়ন্ত্রণে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, আমদানি করা বিটুমিন একে তো নিম্নমানের তার উপর এটিকে ব্যবহারের আগে বারংবার তাপ দেওয়া হয়। ফলে গুণগত মান হারানো পাতলা হয়ে আসা বিটুমিনকে উন্নত ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিনের ভুয়া রূপ দিতে এতে ভেজাল হিসেবে যোগ করা হয় ‘গিলনোসাইড’, মাটি ইত্যাদি।

প্রসঙ্গত, গত ৩ জানুয়ারি চোরাই বিটুমিন চক্রের সক্রিয় ৩ সদস্যকে সীতাকুন্ড থানাধীন বাংলা বাজার এলাকা থেকে প্রায় ১৬ হাজার লিটার চোরাই বিটুমিনসহ আটক করা হয়। গত ২ জুন একই গ্রুপের চোরাই বিটুমিন চক্রের এক সদস্যকে ৫৩ মেট্রিক টন বিটুমিনসহ সীতাকুন্ড থানাধীন দক্ষিণ সোনাইছড়ি ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্বে একটি তেলের ডিপো থেকে আটক করা হয়। র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ড্রামে ড্রামে রাখা ছিলো চোরাই বিটুমিন। যা বিভিন্ন সরকারিবেসরকারি সংস্থার গাড়ি থেকে কম দামে সংগ্রহ করতো আলমগীর হোসেন নামে আটককৃত ব্যক্তি। আর মজুত করা হতো সীতাকুন্ডের সোনাইছড়ির একটি তেলের ডিপোতে। এরপর তিনি এসব বিক্রি করতেন বেশি মূল্যে। ১৭ জুন আউটার রিং রোডের হালিশহর গলিচিপা পাড়ার সাগর পাড় এলাকায় ইদ্রিস প্রকাশ মিন্টুর ডিপোতে অভিযান চালিয়ে তিন জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেখানে ১৮ হাজার লিটারের বিটুমিন ট্যাংক গাড়িগুলোকে থামিয়ে বিটুমিন চুরি করতো চক্রটি। পরবর্তীতে সড়কমহাসড়কের কাজে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতো তারা। ফলে বৈধ বিটুমিন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। গত ১ আগস্ট র‌্যাব, চট্টগ্রামের একটি বিশেষ আভিযানিক দল এই চক্রের আরও তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সীতাকুন্ডের সোনাইমুড়ি এলাকা থেকে।

আসামি দিদারুল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেন খান, কবির এবং তাজুল ইসলাম জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা বিভিন্ন মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে বিটুমিন সংরক্ষণ করে এবং পরবর্তীতে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় করে আসছে। এসময় আসামিদের স্বীকারোক্তি ও দেখানো মতে তাদের হেফাজতে থাকা ৮৫৪টি ড্রাম এবং ২টি ড্রাম ট্রাক থেকে সর্বমোট ১৭৯ মেট্রিক টন চোরাই বিটুমিন এবং বিটুমিন পরিবহনে ব্যবহৃত একটি কাভার্ড ভ্যান জব্দসহ আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়। জব্দকৃত চোরাই বিটুমিনের আনুমানিক মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ভোট কেন্দ্র বেড়েছে ৬২টি
পরবর্তী নিবন্ধসর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি আজ উদ্বোধন