ভেঙে পড়ছে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

কক্সবাজার প্রতিনিধি | শুক্রবার , ৪ নভেম্বর, ২০২২ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

‘কক্সবাজারের একদিকে নয়নাভিরাম পাহাড়, অন্যদিকে সফেন সমুদ্র। মাত্র দুই যুগ আগেও কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র তীরবর্তী পাহাড় ও সমুদ্রের জোয়ারভাটা অঞ্চলের মাঝখানের ভূমির পরিধি ছিল অনেক বিস্তৃত। সেখানে ছিল সুউচ্চ বালিয়াড়ি, বালিয়াড়িতে ছিল বৈচিত্র্যময় লতা গুল্মসহ নানা উদ্ভিদের এক অনন্য প্রাকৃতিক স্থাপত্য। আবার এ প্রাকৃতিক স্থাপত্যরাজিই ছিল কক্সবাজার সৈকতের একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা। অন্যদিকে সমুদ্রতীরের পাহাড়জুড়েও ছিল উদ্ভিদ ও লতাগুল্মের প্রাকৃতিক অলংকার। কিন্তু কক্সবাজার সমুদ্র তীরে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও পাহাড় কাটার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে কক্সবাজারের সৌন্দর্য। সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থাও। অথচ সৈকতের বালিয়াড়ি ও বালিয়াড়ি উদ্ভিদরাজিই উপকূলের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসাবে ভূমিকা রাখে। বড় বড় সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলকে রক্ষা করে। আর এটা অতীতের ঘূর্ণিঝড়ে যেমন বোঝা গেছে, এবারের ঘূর্ণিঝড়জনিত জলোচ্ছ্বাসেও প্রমাণিত হয়েছে’ -বলেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার।
তিনি বলেন, গত মাসে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাব এবং আগস্টের লঘুচাপের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের পর আমাদের এনভায়রণমেন্টাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের বিজ্ঞানীরা কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সৈকত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সেই টিমে জিওলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের বিজ্ঞানীরাও ছিলেন। তারা এই দুর্যোগের প্রভাব সম্পর্কে টানা কয়েকদিন ধরে সৈকতে অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ চালানোর পর একটি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনও তৈরি করেন।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, যেখানে সাগরলতার বালিয়াড়ি ও কেয়া-নিশিন্দার প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে সাগরতীর ভাঙেনি। বরং সাগরলতায় বালি ও আবর্জনা আটকে বালিয়াড়ি আরও উঁচু হয়েছে। আর যেখানে ঝাউবন ও অন্য কোনো উঁচু বাঁধ আছে সেখানেই ক্ষয়ের শিকার হয়েছে সৈকতের মাটি। এর ফলে বিলীন হয়েছে ঝাউবনসহ অন্যান্য স্থাপনা। এতে প্রমাণিত হয়, প্রাকৃতিক জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস করে যেখানে অপরিকল্পিত উন্নয়ন করা হয়েছে সেখানেই ভাঙছে সমুদ্র সৈকত।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, ’৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় থেকে এ প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থাই রক্ষা করেছিল কক্সবাজার-টেকনাফ সাগরতীরের অধিবাসীদের। একই কারণে বেঁচেছিল সোনাদিয়া দ্বীপও। কিন্তু মহেশখালীর মাতারবাড়ি, ধলঘাটা, কালামারছড়া ও পাশ্ববর্তী কুতুবদিয়া দ্বীপে এই প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে মারা যায় হাজার হাজার মানুষ। একই কারণে নোয়াখালীর হাতিয়া ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপসহ চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকাজুড়ে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটায় ০২বি নামের এই ক্যাটাগরি-৪ ঘূর্ণিঝড়টি। অথচ এই প্রলয় থেকে বেঁচে যাওয়া কক্সবাজার-টেকনাফ সাগরতীরে মেরিন ড্রাইভসহ অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা ও স্থাপনা নির্মাণ এবং এককভাবে ঝাউগাছের বনায়নের কারণে সেই সাগরতীর এখন ভাঙছে। আর এ ভাঙনের কারণে মেরিন ড্রাইভসহ সাগরতীরবর্তী স্থাপনা ও ঝাউবাগান বিলীন হয়ে যাচ্ছে সাগরে। সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে সৈকতের সৌন্দর্যও।
বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিমও মনে করেন, সৈকতের যেখানেই জোয়ারের ঢেউকে বাধা দেওয়া হয়, সেখানেই সৈকতের মাটি ক্ষয়ের শিকার হয়। সৈকতের বালিয়াড়িতে সাগরলতাসহ অন্যান্য লতাজাতীয় উদ্ভিদের পরিবর্তে ঝাউগাছ লাগানোসহ নানা স্থাপনা নির্মাণের কারণে প্রাকৃতিক জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। অথচ মাত্র দুই দশক আগেও কক্সবাজার সৈকতের প্রাকৃতিক সুরক্ষা বলয় ও সৌন্দর্য প্রায় অটুট ছিল।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গত দুই যুগে শহরের কলাতলী থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ
সৈকতের গড়ে ৫শ মিটার করে এলাকা সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তবে কলাতলী থেকে হিমছড়ি ও টেকনাফ থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত সৈকতের জমিই বেশি ভাঙনের শিকার হয়েছে। গত মাসে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এবং আগস্টের লঘুচাপের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসেও ভেঙেছে কক্সবাজার সৈকতের বিস্তীর্ণ এলাকা। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে পর্যটন এলাকার সরকারি-বেসরকারি বহু স্থাপনা। তবে এখনও সৈকতের যেখানে প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রয়েছে, সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জলোচ্ছ্বাসে বড় কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন,
কক্সবাজার সৈকতের সৌন্দর্য এখন ইতিহাস। দুর্বৃত্তদের লোলুপ দৃষ্টির কারণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কক্সবাজার।
তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ সৈকত এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষায় সরকার এ সব এলাকাকে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সেখানে সকল ধরনের স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ করলেও প্রভাবশালীরা দেশের প্রচলিত আইন কানুন মানছে না। এমনকি তিন বছর আগে ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে দেয়া উচ্চ আদালতের রায় এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। উপরন্তু অবৈধভাবে সৈকতে একের পর এক ৮/১০ তলা ভবন তৈরি করা হচ্ছে। সেই সাথে পরিবেশ সমীক্ষা ছাড়াই ইনানী সৈকত দ্বি-খণ্ডিত করে প্রভাবশালীদের হোটেলের সামনে জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। কক্সবাজার শহরে উঁচু বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। এর ফলে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সুরক্ষা ও সৌন্দর্য যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তাও হারিয়ে যাবে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ইয়থ এনভায়রণমেন্ট ফোরাম (ইয়েস) সভাপতি ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, এখন কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকত ও সৈকত সংলগ্ন পাহাড়ে চলছে দখলবাজদের রামরাজত্ব। ১৯৯৯ সালে ইসিএ এলাকা ঘোষণার পর সৈকতে নির্মিত সকল স্থাপনা অবৈধ ঘোষণা করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন। এ ছাড়াও ২০১১ সালে জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার স্বার্থে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক থেকে টেকনাফ বদরমোকাম পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সৈকতে যে কোনো ধরণের স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ।
কিন্তু প্রচলিত আইন ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে সাম্প্রতিক সময়ে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। বালিয়াড়িতে অবৈধভাবে বসানো হচ্ছে চেয়ার-ছাতা। সৈকতে লাল কাঁকড়ার প্রজনন বিধ্বংসী বিচ বাইক চালানো হচ্ছে জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে। তিনি বলেন, এদের থাবাকে থামানো না গেলে
কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। আর কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে গেলে পর্যটন শিল্পও ধ্বংস হয়ে যাবে।
সমুদ্র উপকূলের সুরক্ষা নিয়ে নেদারল্যান্ড ও কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাহ নেওয়াজ চৌধুরী। তিনি বলেন, কক্সবাজার সৈকতে একসময় বালিয়াড়ি ছিল, বালিয়াড়ির ওপর সাগরলতাসহ নানা ধরণের লতা-গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ ছিল। এগুলো সৈকতের সুরক্ষায় প্রাকৃতিকভাবে কাজ করত। কিন্তু পর্যটকদের চলাফেরার কারণে সাগরলতা মরে গেছে, বালিয়াড়িগুলোও নেই। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশ তা যত্ন করে রেখে দেয়। আমাদের সৈকতের কিছু জায়গা সুরক্ষিত করা দরকার ছিল।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী বলেন, সমুদ্র তীরবর্তী ভূমির যে ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য থাকে, তা উপেক্ষা করে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা গড়া হয়েছে কক্সবাজারে। যে কারণে সাগর তীর ভাঙছে। তিনি বলেন, সমুদ্র ও মূল ভূ-খণ্ডের মাঝখানে সমান্তরালভাবে একটি জলাভূমি ও সৈকত থাকে। ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সাগরের উপচে পড়া জোয়ার সৈকতের বালিয়াড়িতে আঁচড়ে পড়ে। এ সময় কিছু পানি বালিয়াড়ি পেরিয়ে জলাভূমি অথবা ক্যানেলের মতো ছোট জলধারায় জমা হয়। যে জলাধারাটি সৈকতের সাথে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়ে এক প্রান্তে গিয়ে বড় জলধারার মাধ্যমে সাগরে মিলিত হয়। আর এই ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য যতদিন অবশিষ্ট ছিল, প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাও প্রায় অক্ষুণ্ন ছিল।
এই পরিবেশ বিজ্ঞানী বালিয়াড়িতে স্থাপনা নির্মাণ ও ঝাউগাছের মতো দীর্ঘ উচ্চতার বৃক্ষ লাগানোর বিরোধিতা করে বলেন, সৈকতের অগ্রবর্তী অংশে দীর্ঘ উচ্চতা সম্পন্ন বৃক্ষের ঢাল সৃষ্টির কারণে বালিয়াড়িগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে এবং সাগর তীরে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। তিনি বলেন, গভীর সমুদ্র থেকে শত শত মাইল পেরিয়ে বিনা বাধায় ধেয়ে আসা বাতাস সৈকতে এসে হঠাৎ ঝাউগাছের মতো দীর্ঘ উচ্চতাসম্পন্ন প্রাকৃতিক ঢালে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নীচের দিকে চাপ তৈরি করে এবং এতে বালিয়াড়ির মাটি সরে যায়। এর ফলে সাগরতীর ভেঙে যায়। আর গত মাসে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এবং আগস্টের লঘুচাপের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজার সৈকতের শত শত ঝাউগাছ ভেঙে পড়ে। তিনি কক্সবাজার সৈকতের টেকসই সংরক্ষণে একটি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
তবে বর্তমানে কক্সবাজার সৈকতের ৭০% ভাগ জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং বাকি ৩০% ভাগও অত্যন্ত ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার।
তিনি মনে করেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে কক্সবাজার সৈকতে যে পরিবেশগত ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে তা কখনও পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা যাবে না। তবে আমরা যদি এখন থেকে উদ্যোগ নিই, তাহলে অন্তত ৭০-৮০% ভাগ পরিবেশ আমরা পুনর্গঠন করতে পারব বলে আশা রাখি।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত রক্ষায় বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের নেতৃত্বে একটি জাতীয় সুরক্ষা কমিশন গঠনের দাবি জানান কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের আহ্বায়ক আ ন ম হেলাল উদ্দিন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে ৫ পুলিশ বরখাস্ত
পরবর্তী নিবন্ধসালিশি বৈঠকে মারধর, যুবকের মৃত্যু