ভূমি নিয়ে সক্রিয় জালিয়াত চক্র

নগরে উন্নয়ন প্রকল্প ।। প্রবাসী, বিধবা ও অসহায় মানুষকে টার্গেট ।। বেড়েছে মামলা, সিডিএ ও এলএ শাখায় আটকা অনেক চেক

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২৯ জুন, ২০২২ at ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ

নগরীতে বাস্তবায়নাধীন নতুন নতুন রাস্তার কারণে ভূমির মান এবং দাম বাড়ার সুযোগে সংঘবদ্ধ চক্র নানাভাবে প্রতারণা শুরু করেছে। উন্নয়নের এই ধারার অপব্যবহার করে বহু মানুষকে পথে বসানোর চেষ্টা চলছে। ভূমি অফিস, এলএ শাখা এবং পুলিশ মিলে সংঘবদ্ধ চক্র নানা কৌশলে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলছে। বিশেষ করে প্রবাসী, বিধবা এবং অসহায় মানুষকে টার্গেট করে চক্রটি নানা জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে। ইতোমধ্যে মামলা মোকর্দমায় জড়িয়ে অনেক মানুষের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। নগরীর থানা এবং আদালতে এই ধরনের ভূমি বিরোধকে ঘিরে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মামলা হচ্ছে। চট্টগ্রামে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। গত কয়েক বছর ধরে নতুন নতুন অনেক রাস্তাঘাট তৈরি হচ্ছে। পতেঙ্গা-ফৌজদারহাট লিংক রোড, ফৌজদারহাট বায়েজিদ লিংক রোড, কালুরঘাট-শাহ আমানত ব্রিজ বাঁধ কাম আউটার রিং রোড, বঙ্গবন্ধু টানেল, টানেলের অ্যাপ্রোচ রোড, বাকলিয়া এঙেস রোডসহ কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। উপরোক্ত সড়ক নির্মাণের প্রকল্পগুলোর প্রায় পুরোটাই তৈরি হচ্ছে নতুন এলাকা দিয়ে। ওইসব স্থানে আগে কোনো রাস্তাঘাট ছিল না। জায়গাগুলো ছিল পতিত। রাস্তার কারণে ভূমিগুলো কোটি কোটি টাকার সম্পদ হয়ে উঠেছে। এক একর জমি এক-দুই লাখ টাকায় বিক্রি করতে কষ্ট হতো। সেখানে এখন কাঠা বিক্রি হচ্ছে ১৫/২০ লাখ টাকায়। মৌজা দরের তিন গুণ ক্ষতিপূরণ পাওয়া এসব প্রকল্প এলাকায় যাদের ভূমি রয়েছে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। তবে এই লাভ অনেকের জন্য গলার কাঁটা হয়েছে।

জানা গেছে, রাস্তার জন্য হুকুমদখলকৃত ভূমির ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রধান শর্ত হচ্ছে জমির নিষ্কণ্টক মালিকানা। বিএস খতিয়ান থেকে শুরু করে সব কাগজপত্র হালনাগাদ থাকতে হয়। দীর্ঘদিন অবহেলায় প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা ভূমি মালিকদের অধিকাংশেরই কাগজপত্র আপডেট ছিল না। রাস্তা নির্মাণ এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ফলে কাগজপত্র আপডেট করতে গিয়ে নানাভাবে সমস্যায় পড়ছেন। উন্নয়ন প্রকল্প এলাকায় অনেক জায়গার মালিকানা দাবি করছে পরস্পর বিরোধী একাধিক পক্ষ। এতে করে কোনো পক্ষই ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না। সিডিএ কিংবা এলএ শাখায় চেক আটকা পড়েছে। চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষতিপূরণের অর্থের একটি অংশ এভাবে আটকা পড়ে রয়েছে। এসব ভূমির ব্যাপারে সৃষ্টি হচ্ছে মামলা। এসব মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো পক্ষই ক্ষতিপূরণের চেক পাচ্ছে না। আবার কোথাও কোথাও জমি রাতারাতি দখল-বেদখলের ঘটনা ঘটছে। ভূমির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এই ধরনের দখল-বেদখল এবং মামলার ঘটনা ক্রমে বাড়ছে। বিশেষ করে প্রবাসী ও বিধবাদের টার্গেট করে সংঘবদ্ধ চক্র মাঠে সক্রিয় রয়েছে।

পতেঙ্গা-ফৌজদারহাট লিংক রোডের সমুদ্র উপকূলের অনেক ভূমি নিয়ে একের পর এক মামলা হচ্ছে। মামলা হচ্ছে বাকলিয়া এঙেস রোডে। কালুরঘাট-শাহ আমানত সেতু লিংক রোডের পাশের অনেক ভূমি নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে বিরোধ। ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার পরও রাতের আঁধারে জমিতে এসে সাইনবোর্ড দিয়ে মালিকানা দাবি করা হচ্ছে। পুলিশ ও ভূমি অফিসের সদস্যদের সহযোগিতায় সংঘবদ্ধ ভূমিদস্যু চক্র নানাভাবে অসহায় মানুষদের হয়রানি করছে। প্রবাসীদের পক্ষে দেশের জমিজমা ঠিকভাবে ম্যানেজ করা কঠিন। অনেক সময় মামলার দেন-দরবারেও তারা সময় দিতে পারেন না। আর এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে সংঘবদ্ধ চক্রটি কোটি কোটি টাকার সম্পদ বেহাত করে দিচ্ছে। বিধবা কিংবা অসহায় মানুষের সম্পত্তিও হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।

একাধিক ভুক্তভোগী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সব কাগজপত্র থাকলেও পুলিশ এবং ভূমি অফিসে গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধ চক্র নানা জটিলতা তৈরি করছে। জায়গা সম্পত্তির মামলা আদালতে হলেও থানা পুলিশের একটি বড় ভূমিকা থাকে। আর এই ভূমিকাকে পুঁজি করে পুলিশ নানাভাবে বাণিজ্য করে বলে তারা অভিযোগ করেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, সিডিএ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় বহু অনুন্নত এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। পরিত্যক্ত ও পতিত অনেক ভূমির দাম আকাশ ছুঁয়েছে। রাস্তার কারণে প্রতি কাঠা জায়গার দাম ৬০/৭০ লাখ টাকায় উঠেছে। বাকলিয়া এঙেস রোড এলাকায় প্রতি কাঠা ভূমি ৫০ লাখ টাকার বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। হালিশহর, ফৌজদারহাট, কালুরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় জায়গার দাম প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে বিরোধ বাড়ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের চেক সিডিএ এবং এলএ শাখায় আটকা পড়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে সিডিএর কিছু করার নেই। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী জায়গার মালিকানা নিষ্কণ্টক না হওয়া পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদানের সুযোগ নেই।

বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কাগজপত্রের সমস্যার কারণে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বহু চেক হস্তান্তর করা যাচ্ছে না। অনেক জমিতে মালিকানার বিরোধ তৈরি হয়েছে। জায়গা-জমির গুরুত্ব এবং দাম বেড়ে যাওয়ায় বিরোধ বাড়ছে। তবে বর্তমানে ভূমি মালিকানার কাগজপত্র যেভাবে তৈরি হচ্ছে তাতে এই ধরনের অনাহূত বিরোধ কমে যাবে। অনলাইন সুবিধা জালিয়াতি করার দিন শেষ করে দিচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিধিনিষেধ মানতে হবে, মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক
পরবর্তী নিবন্ধমাঠে ঢুকতে কেন বাধা