কক্সবাজারের পেকুয়া ভূমি অফিসের প্রধান সহকারী তপন কান্তি পাল কর্তৃক ঘুষ দাবির অভিযোগ তুলে উপজেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কাফনের কাপড় পড়ে অনশনে থাকা কৃষক মুবিনুল হক ২৭ ঘণ্টা পর বাড়ি ফিরেছেন।
গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে অনশনরত মুবিনুল হককে দেখতে যান উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. জাহিদুল ইসলাম। এ সময় তিনি অনশনরত মুবিনুল হককে জুসসহ খাদ্যদ্রব্য খাইয়ে অনশন ভাঙান। সাথে এসি ল্যান্ড আশ্বাস দেন, ঘুষ দাবির অভিযোগ সঠিক থাকলে তপন পালের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের। সেই আশ্বাসের ভিত্তিতে কৃষক মুবিন তাঁর অনশন ভাঙেন এবং রাতেই বাড়ি ফেরেন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার দিকে ভূমি অফিসের প্রধান সহকারী তপন কান্তি পালের শাস্তি চেয়ে পেকুয়া কলেজ মাঠে অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ব্যানার টাঙিয়ে একাই কাফনের কাপড় পরে অনশনে বসেন মুবিনুল হক (৫৫)। তিনি পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের পূর্ব বাইম্যাখালী গ্রামের মৃত বরকত আলীর পুত্র।
মুবিনুল হকের দাবি, উপজেলা ভূমি অফিসের প্রধান সহকারী তপন কান্তি পাল তাঁর ফাইল আটকে রেখে দুই লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। তন্মধ্যে তিনি এক লাখ টাকা ঘুষ প্রদানও করেন। বাকি এক লাখ টাকা না দিলে তাঁর খতিয়ান কর্তন করার হুমকি দেন তপন কান্তি।
কৃষক মুবিনুল হক আরো দাবি করেন, বিষয়টি নিয়ে কয়েকদিন ধরে অনেক সাংবাদিকের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা নীরব ছিলেন। তাই এই অনশন শুরু করেছিলেন।
কী কারণে ভূমি কর্মকর্তা ঘুষ দাবি করেছিলেন? এমন প্রশ্নে মুবিনুল হক বলেন, তাঁর অংশের জমি নিয়ে বোনদের আপত্তি ছিল। শুনানি শেষে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম সেই আপত্তি খারিজ করে দেন। খারিজ আদেশের সার্টিফাইড কপি নেওয়ার জন্য উপজেলা ভূমি অফিসের প্রধান সহকারী তপন কান্তি পালের কাছে গেলে তিনি দুই লাখ টাকা দাবি করেন। এই টাকা না দিলে তাঁর খতিয়ান কর্তন করে বোনদের নামে খতিয়ান সৃজন করে দেওয়ারও হুমকি দেন।
মুবিনুল হকের ভাষ্য– বিষয়টি নিয়ে গত একবছর ধরে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাকে। এজন্য প্রতিনিয়তই ভূমি অফিসে যাওয়া–আসা করতেন তিনি। যার প্রমাণ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই পাওয়া যাবে।
এই বিষয়ে অভিযুক্ত পেকুয়া উপজেলা ভূমি অফিসের প্রধান সহকারী তপন কান্তি পাল দাবি করেন, ‘যে কৃষক আমার বিরুদ্ধে শহীদ মিনারে অনশন করেছেন, তাকে এক পলকের জন্যও দেখিনি। তার কাছে ঘুষ চাওয়া বা নেওয়ার কোনও প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া মুবিনুল হক যে বিষয়টি এখানে উত্থাপন করেছেন, সেটি আমার কাজ নয়। কৃষক মুবিনুলের কাজটি ছিল কানুনগো, সার্ভেয়ার সহ সর্বোপরি এসি ল্যান্ড স্যারের কাছে। আর মামলা রুজু বা খারিজ সংক্রান্ত সার্টিফাইড কপি দেওয়ার কাজও আমার নয়। সেই কাজটি দেখভাল করেন অন্য কেউ।’
তিনি আরও বলেন, ‘মূলত চাঁদাবাজ–ধান্ধাবাজ শ্রেণীর তৃতীয় একটি পক্ষ আমাকে এখান থেকে সরানোর জন্য ঘুষ দাবির কল্পকাহিনী সাজিয়ে এমন ঘৃন্য কাজটি করেছে। ইতোমধ্যে আমাকে পেকুয়া থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছি ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। কারণ পেকুয়ায় সরকারি কোনও অফিসের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা ঠিকমতো সরকারি দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না ওই চক্রের কারণে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে– পেকুয়া সদর ইউনিয়নের পূর্ব বাইম্যাখালী গ্রামের মৃত আবদুল হামিদের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পত্তির রেকর্ডিয় মালিক হন বরকত আলী। সেই বরকত আলী এক স্ত্রী, তিন পুত্র ও চার কন্যা রেখে মারা যান। কিন্তু চার কন্যা এবং এক পুত্রকে গোপন করে বরকত আলীর সম্পত্তি স্ত্রী ও দুই পুত্র মিলে খতিয়ান সৃজন করে ফেলেন। তবে চার কন্যার জায়গা তাদের দখলেও রয়েছে বর্তমানে। পরবর্তীতে চার কন্যা তাদের ওয়ারিশি সম্পত্তির নামজারি খতিয়ান সৃজন করতে গেলে জানতে পারেন, ওয়ারিশ হিসেবে তাদের (চার বোন ও এক ভাই) বাদ দিয়ে মা এবং দুই ভাই পুরো সম্পত্তিই নামজারি করে ফেলেন। এর পর সেই খতিয়ান বাতিলের জন্য চার বোনের পক্ষে জুবাইদা খানম গং সহকারী কমিশনারের কাছে রিভিউ মামলা (৩৩/২০২২) রুজু করেন। সেই রিভিউ মামলার কয়েকদফা শুনানি শেষে পুরো খতিয়ান বাতিলের আদেন দেন।
কানুনগো, সার্ভেয়ার রিপোর্ট পাওয়ার পর গত ৩০ এপ্রিল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আদেশ দেন যে, রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন ১৯৫০ এর ১৫০ (১) ধারার বিধান মতে নথি রেকর্ড পর্যালোচনায় রেকর্ডিয় মালিক বরকত আলীর ওয়ারিশগণের মধ্যে রেজিস্ট্রার্ড অংশনামা বা বণ্টননামা না থাকায় বণ্টননামা ছাড়াই এবং অন্যান্য ওয়ারিশগণকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র স্ত্রী ও দুই পুত্রের নামে ওয়ারিশ সূত্রে নামজারি মামলা মূলে খতিয়ান সৃজন করায় পেকুয়া মৌজার সৃজিত নালিশী ৭১৯২ নম্বর খতিয়ানটি বাতিল করা হলো। উক্ত খতিয়ানের সম্পূর্ণ জমি পূর্ববর্তী খতিয়ানে পুনর্বহালের আদেশ দেওয়া হলো। এই বিষয়ে পেকুয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম গতকাল বিকেলে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমার অফিসের প্রধান সহকারী তপন কান্তি পালকে নিয়ে শহীদ মিনারে অনশন করছেন কৃষক মুবিনুল হক।
এই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্থানীয় সাংবাদিক মারফত জানার পর শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে শহীদ মিনারে গিয়ে কৃষক মুবিনুল হকের অনশন ভাঙাই। এ সময় তাকে বলেছি, যদি আমার অফিসের কেউ অনৈতিক কোনও কিছু দাবি করে তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
সার্টিফাইড কপি দেওয়ার বিপরীতে ২ লাখ টাকা ঘুষ দাবির প্রসঙ্গে এসি ল্যান্ড বলেন, ‘তপন পাল তো প্রধান সহকারী। কোনও রিভিউ মামলার সার্টিফাইড কপি দেওয়ার কাজ তো তার নয়। তাছাড়া এই বিষয়ে কৃষক মুবিনুল হক তো আমার কাছেও আসেনি।’
তাহলে কৃষক অনশন কেন করতে গেলেন, এমন প্রশ্নে এসি ল্যান্ড আরও বলেন, ‘আসল কথা হচ্ছে, মৃত বরকত আলীর সম্পত্তির ওয়ারিশদার হচ্ছেন স্ত্রী, তিন পুত্র ও চার কন্যা। কিন্তু ওয়ারিশ হিসেবে এক পুত্র ও চার কন্যার ভাগের সম্পত্তিও স্ত্রী এবং দুই পুত্র তাদের নামে নামজারি খতিয়ান সৃজন করে ফেলেন।
সেই খতিয়ানের ওপর আপত্তি দাখিল করেন চার বোন। এর পর ওয়ারিশ গোপন করে পুরো সম্পত্তি স্ত্রী এবং দুই পুত্র মিলে নামজারি করার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় সৃজিত খতিয়ান বাতিল করে পূর্ববর্তী খতিয়ানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর এতেই এতসব কাহিনী সামনে আনা হচ্ছে।’
এসি ল্যান্ড বলেন, ‘আমার অফিসের কোনও কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি কারো কাছ থেকে ঘুষ দাবি করেছেন বা নিয়েছেন এমন প্রমাণ পেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আবার কেউ যদি অসৎ উদ্দেশ্যে ভূমি অফিসের কারো নামে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে থাকেন তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’