বাংলাদেশে যখন কোন ভূমিকম্প, মহামারী বা বড়ধরনের দুর্যোগ আসে এবং মানুষের মৃত্যুসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় তখনই আমরা বিষয়টা নিয়ে নড়েচড়ে বসি এবং চারিদিকে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। এখন সত্যিকথা হল বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভূমিকম্পের আতংক জেকে বসেছে। ভূমিকম্পই একমাত্র এমন এক ধ্বংসলীলা যার আগাম কোন সংকেত বা পূর্বাভাস মানুষ পায় না। তবে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞগণ তাদের গবেষণা ও অনুমানভিত্তিক ধারণার উপর ভূমিকম্পের সতর্কবার্তা দিয়ে যান। বাংলাদেশ যে এখন অনেকটা ভূমিকম্প উৎপত্তিস্থলের জায়গা তা গত ২১ ও ২২ নভেম্বর অল্প সময়ের ব্যবধানে তিন তিনটা ভূমিকম্পের মারাত্মক ধাক্কায় সবাইকে কাঁপিয়ে দিয়ে তা জানান দিয়েছে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই ধরনের ঘন ঘন মৃদু ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পেরই পূর্বাভাস। তারা বলছেন ইন্ডিয়ান, ইউরোপীয় এবং বার্মীজ এই তিনটি টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলের উপর অবস্থান করছে ভূঅভ্যন্তরীণ বিপুল পরিমাণ সঞ্চিত শক্তি। বাংলাদেশ এর একটি সক্রিয় জোন বিশেষ করে সিলেট থেকে কক্সবাজার অঞ্চলের নিচে বড় ধরনের শক্তি জমা হচ্ছে বলে তাদের ধারণা। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন এই অঞ্চলে একটি বড় লকজোন তৈরী হয়েছে যেখানে প্লেটগুলো আটকে আছে। তারা জানান প্রায় আটশ থেকে হাজার বছর আগে এখানে বড়সড় ভূমিকম্প হয়েছিল আর সেই শক্তি নতুন করে সঞ্চিত হওয়ায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার জন্ম নিয়েছে। তারা বলছেন বাংলাদেশে গত ২১ ও ২২ নভেম্বরের ভূমিকম্পের কম্পন হয়তো আটকে থাকা প্লেটের অবস্থান বদলাচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জরিপমতে গত ৫ বছরে ৩৯ টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশের ভূখণ্ড। আর এর ২৮ থেকে ৩০ শতাংশের উৎপত্তিস্থল ঢাকার ৬ থেকে ৮৬ কিঃমিঃ এর মধ্যে। জরিপে দেখা গেছে রাতের বেলায় ভূমিকম্প বেশি হয়। ফলে ব্যাপক মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও তাতে অধিক। গবেষণায় জানা যায়, গত ৫ বছরে সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ১২ টার মধ্যে ১৪ টি, রাত ১২ টা থেকে সকাল ৬ টা পর্যন্ত ৯ টি, সকাল থেকে দুপুর ১২ টার মধ্যে ১১ টি, দুপুর ১২ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত ৫ টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর মতে ভূমিকম্পের পর আফটার শক হবে ধারণা। ভূ–অভ্যন্তরে যে ফাটল বা ফল্ট লাইন এতদিন ধরে প্রচণ্ড চাপে একে–অপরের সঙ্গে আটকে আছে, তা নড়তে শুরু করেছে এবং শক্তি নির্গমন হচ্ছে। আফটার শক হতে হতে বড় ভূমিকম্পের সূত্রপাত ঘটে।
এখন ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটুকু তাই হল সবচেয়ে বড় প্রশ্ন । বড় ধরনের কোন বিপর্যয়ে সরকার শক্তভাবে হ্যান্ডেল করতে পারবে কিনা তা সার্বিকভাবে ভেতরেবাহিরে আঁচ করা যাচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় ন্যাশনাল অপারেশন সেন্টার নির্মাণে চায়নার সঙ্গে একদশক আগে যে চুক্তি হল তারও কোনও সুফল বা অগ্রগতি নাই। বড় ধরণের কোন দুর্যোগের সশস্ত্রবাহিনী ও ফায়ার ডিফেন্স কতটুকু ভুমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়েও রয়েছে নানামত। দেশে আশি হাজারের মত স্বেচ্ছাসেবক থাকলেও তারা নিধিরাম সর্দার। তাহলে আশঙ্কা থেকেই বলা যায় বড় ধরনের ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশের সার্বিক প্রস্তুতি ও করণীয় যথেষ্ট নয়। গত ২১ নভেম্বর ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই গত ২৮ ডিসেম্বর একদিনে আবারো ভোর ৩ টায় ৪ মাত্রার, সকাল ৬ টায় ৩.৫ মাত্রার এবং বিকেল ৪টায় ৩.৬ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। গবেষণায় বলা হচ্ছে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশে আরেকটি সক্রিয় ফাটলরেখার দেখা মিলেছে যা বাংলাদেশের ভেতরে পড়ছে।
অনেকের ধারণা, ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমায় কিন্তু তা আদৌ সঠিক নয়। মার্কিন ভূপদার্থবিজ্ঞানী মাইকেল স্টেকলার যিনি বাংলাদেশ ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্পের মাঠ গবেষণায় প্রায় ২০ বছর ধরে কাজ করেছেন তার মতে ছোট ছোট ভূমিকম্পে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা থেকেই যায়।
তাই এখনি সময় ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয় ঠিক করা, ভূমিকম্পের সময় জান বাঁচাতে কী করা উচিত তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন করা, এলাকায় পাড়া মহল্লায় প্রজেক্টটার দিয়ে প্রচারণা চালানো, পাঠ্যবইয়ে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা, জুম্মার নামাজে ইমামদের খুৎবায় বর্ণনা করা, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে এই বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা। প্রশিক্ষিত টিম গঠন করা। পুরাতন জীর্ণ ভবন ভেঙে ফেলা। ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানতে বাধ্যতামূলক করা, সরুরাস্তা অলিগলিতে উদ্ধারকাজ চালানোর কর্মপদ্ধতি ঠিক করা অতীব জরুরি।
লেখক: প্রাবন্ধিক।











