দক্ষিণ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কিছু বিখ্যাত গান আর নাটক আছে। এসব গান আর নাটকের থিম অত্যন্ত বিজ্ঞ ও শিক্ষণীয়। দৈনন্দিন জীবনের অসংখ্য অসংগতি ভাষা ও সুরের মাধ্যমে আমজনতার কাছে তুলে ধরা হয়। জনতা আসলেই ক্ষণিকের জন্য হলেও অসঙ্গতি দোষ ত্রুুটি গুলো নিয়ে ভাবে, সমাধান তো আর আমজনতার হাতে নেই। দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটা আঞ্চলিক গানের শুরু এভাবে ‘যার ঘরত গাই গরু নাই, ইতা বেচের দই’-বাংলায় এর অর্থ যার ঘরে গাই গরু ও নাই সে বিক্রি করছে কিনা দই। অর্থাৎ কোন কাজটাই যোগ্য মানুষ দিয়ে হচ্ছে না। সামাজিক ভাষায় যে দেখি তাকাই শুধু দুই নম্বরী।
পেশাগত জীবনের বাইরে বিভিন্ন সামাজিক কাজে জড়িত থাকতে হয়। তাই লোকে যাকে ‘আঠার জাতের মানুষ’ বলে আমার ও সে রকম হরেক কিসিমের মানুষের সাথে মেলামেশা। চকবাজারে সবজি বিক্রেতা আমাকে ভরদুপুরে এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে, দোকানী বলে,ডাক্তার সাব,আপনাদের মত ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতাল নষ্ট করেছেন, পিএইচডি ওয়ালারা ইউনিভার্সিটি নষ্ট করেছেন, ভরৎংঃ-পষধংং পাওয়া ব্যক্তিরা প্রশাসন বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান বলেন সব নষ্ট করেছেন। সুখে আছেন আপনারা, কষ্টে আছে আমজনতা। দোকানীর কথাটা কত তীব্র। অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ তার যাদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলা আমি তাদের সৎ বিবেকের কাছেই সোপর্দ করলাম।
ঘটনা এক: উচ্চস্তরে অফিসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই সবার নজর কাড়ে এমন সব ব্যক্তিদের ছবি ও তাদের কিছু কথন অত্যন্ত সুন্দর ফ্রেমে বাঁধাই করে সিঁড়ির দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক কথা, অনেক পংক্তি, সব মনে নেই। রবীন্দ্রনাথের অপমান কবিতার লাইন যারে তুমি পশ্চাতে ফেলিছ সে তোমারে টানিছে যে পিছনে, নজরুলের মানুষ ও সাম্যের পংক্তি, সুকান্তের ‘ছাড়পত্র’ কবিতার পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার অঙ্গীকার ইত্যাদি। এই লাইনগুলো দেখলে মনে হয় এই অফিসের কর্ণধারগণ াবৎু যরময ধবংঃযবঃরপ য়ঁধষরঃু (অতি উচ্চ মার্গীয় সুকুমার বৃত্তির) অধিকারী। ওখানে যারা যায় ওরা প্রত্যেকেই কমবেশি উপরি দিয়ে ফেরেন। উপরে ছাড়া টেবিল চেয়ার ও কথা বলে না। অথচ সরকার তাদেরকে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। এটা একটা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন,এর থেকে উত্তরণ কি হবে না কখনো? বঙ্গবন্ধুর উক্তির যে যার মতো মতলব হাসিলের ব্যবহার দৃশ্যমান। কিন্তু জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণের একটি উক্তি- আপনাদের বেতন দেওয়া হয় জনগণের ট্যাক্সের পয়সায়। আপনারা জনগণের সেবক হয়ে থাকবেন। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর মুক্ত আলোচনা হওয়া উচিত সেবা-গ্রহীতা ও সেবকদের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা ও সমাধান নিয়ে, ‘সেবক’ নিয়ে জাতির পিতার প্রথম উপলব্ধির ব্যত্যয় হওয়া জাতীয় অসংগতি।
ঘটনা-দুই: পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে শিক্ষা বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক। পশ্চিমবাংলার গণমুখী গায়ক নচিকেতার একটি গানের কলি- হরেক রকম জিনিস বেচি- যে যা নিবি ভাই্ত এর মত স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রও হরেক রকম “শিক্ষা বেচি- যে যা নিবি ভাই’ এর মত অবস্থা। দুই বছর যাবত মানুষের মত শিক্ষা ও করোনা আক্রান্ত, আমাদের দেশে দীর্ঘ লকডাউনের পর অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়, তার বিপরীতে বিলাতেও বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে বাচ্চাদের পড়া ও ক্লাস আগাগোড়া চলছিল, বন্ধ হয়নি। আমাদের নীতিনির্ধারকরা সাবধানতা হিসেবে পরিস্থিতির কারণে বাচ্চাদের স্কুলও বন্ধ করে দেয়। পরে অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়। বড়লোকদের বাচ্চারা ল্যাপটপে অনলাইন ক্লাস করে কিন্তু সমস্যা হয়েছে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বাচ্চাদের নিয়ে। সেখানে এন্ড্রয়েড মোবাইল, ল্যাপটপ ও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট কানেকশন কয়জনের আছে? এমনই এক হতভাগা জননী পুতুলের মা, পুতুলের মা বুয়ার কাজ করে বাসায় বাসায়,পুতুল থাকে নানীর সাথে বাসায়, প্রথম শ্রেণির ছাত্রী, ‘সবার জন্য শিক্ষা’র সময়ে পুতুলের মা আরও লক্ষ লক্ষ সেই শ্রেণির মানুষের মত মেয়ের জন্য অনলাইন ক্লাস করতে পারিনি। কিন্তু যৎসামান্য আয় থেকে ৭০০ টাকা দিয়ে টিউশন দিয়েছে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাস ফেল না থাকার যুগেও পুতুল ১২ মাস টিউশন করে ও ২য় শ্রেণীতে প্রমোশন পায় নি।
হরেক রকম শিক্ষাব্যবস্থায় এই হতদরিদ্রের বাচ্চাদেরকে বর্ণ শব্দ কে শেখাবে? মা-বাবা টিউটর? না স্কুল শিক্ষক? এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মা-বাবা উভয়ই বর্ণ-শব্দ শেখানোর ক্ষমতাও রাখে না। জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত থাকায় সময়ও নেই। প্রাথমিক শিক্ষার প্রারম্ভে যেন এই বাচ্চাগুলোকে হাতে ধরে- আদরে যত্নে বর্ণ, শব্দ শেখানোর জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক দেওয়া হয় তাতে ওরা হয়তো সহজে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রমোশন পাবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের অর্থ-বরাদ্দের কমতি নেই। কিন্তু পুতুলকে বর্ণ, বানান শেখাবে কে? এদিকটা প্রাথমিক শিক্ষার বিচিত্র অসঙ্গতি জীবনের প্রারম্ভে প্লে, নার্সারি, কেজিতে বর্ণ, বানানো শিখবে- মাসিক বেতন কয়েক হাজার থেকে শুরু। ডোনেশনও লক্ষ টাকা-বৈষম্যের বড় অসঙ্গতি আর কি হতে পারে?
ব্রিটিশ বাংলায় ও মা বাবা পড়ালেখা জানত না অনেকে, কিন্তু তাদের বাচ্চারাও প্রাথমিকে বর্ন, বানান স্কুলে শিখেছে, খড়ি মাটি দিয়ে ব্লাক বোর্ডে বাচ্চারা প্র্যাকটিস করে শিখেছে। সর্বোপরি টিউশন দিয়েও প্রমোশন না পাওয়ার সিস্টেম ছিলনা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের নিশ্চিত করা মৌলিক অধিকারের মধ্যে একটি হচ্ছে শিক্ষা। জীবনের প্রারম্ভিক শিশু শ্রেণিতে কিভাবে টিউশন ছাড়া বর্ণ-বানান ক্লাসেই শেখানো যায় এবং সর্বোপরি পুতুল জাতীয় বাচ্চাদের কে কিভাবে শেখানো যায় সেদিকে নজর দেওয়া কর্তব্য।
ঘটনা তিনঃ অনলাইন ফুডের রমরমা ব্যবসা চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের চতুর্দিকে সন্ধ্যার পর যে উচ্চবিত্তের খাদ্য মেলা হয় তা চট্টগ্রামের দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে অন্যতম। দেখলে মনে হবে দেশে সবাই খাবার যেন উপচে দিচ্ছে। এর বিপরীত চিত্রের বিস্তৃত বিবরণ পুষ্টিহীন কোটি মানুষ। উপচে পড়া খাদ্যভ্যাসে মাঝে ৩০-১-২২ তারিখ প্রথম আলো পত্রিকায় সংগ্রামী জীবনের এক মানুষী শিউলি আক্তার এর নবম শ্রেণি পড়া অবস্থায় নিম্নবিত্তের স্বামীর পা সাথে বিয়ে ও তার ডাক্তারী হওয়ার চমকপ্রদ কাহিনী। ডাক্তার শিউলি আক্তারকে জিজ্ঞেস করা হয়, মাসের প্রথম কামাই দিয়ে কি করবেন? ডাক্তার মহিলার সগর্ব উত্তর, মায়ের হাতে পয়লা বেতন দিবেন ও ছেলের জন্য ১ কেজি গরুর মাংস কিনবেন। কারণ তার ছেলে অভাবের দিনে তাকে নাকি বলেছিল, মা তুমি আমার জন্য ১ কেজি মাংস কখন কিনবে? একথা শুনে পাশের বাড়ির এক মহিলা এক বাটি রান্না করা গরুর মাংস দিয়ে গিয়েছিল। চট্টগ্রাম-ঢাকাই বাংলাদেশ নয়। আরও গ্রাম আছে, আরও শহর আছে, আরো জনপদ আছে। অ ঃধষব ড়ভ ঃড়ি পরঃরবং এর মত- দুই বিপরীত মেরুর গল্প। একদিকে ৫ হাজার মানুষের দাওয়াত, বস্তা বস্তা উচ্ছিষ্ট খাবার ডাস্টবিনে- অপরদিকে একটু গরুর মাংস খাওয়ার উদগ্র বাসনা। এই অসঙ্গতির লজ্জা উপরের তলার মানুষদেরই বেশি হওয়া উচিত।
এত অসঙ্গতি, এত বৈষম্য তো হওয়ার কথা ছিল না। ৩০ লক্ষ শহীদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত একটি স্বাধীন দেশ ৫২ বছর কম সময় নয়। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বর্তায় সবজির দোকানী যাদের কথা আক্ষেপের সুরে ইঙ্গিত করেছেন সেই সব শিক্ষিত ‘সেবকদের’ উপর। এর সাথে তো রাজনীতিবিদদের দায়িত্বও সবার অগ্রে। তারা যদি মনে করেন- হেসে খেলে জীবন যায় যদি যাক না-তবে আমজনতার দোকানীর মতে আক্ষেপ ছাড়া করার আর কিছুই থাকবে না।
লেখক : কলামিস্ট, চিকিৎসক।