উত্তর চট্টগ্রামের একটা টপ্ ক্লাস হাই স্কুল কাটিরহাট হাই স্কুল। স্কুল স্থাপিত ১৯৩৩ সালে। আমি ভর্তি হই ১৯৬৪ সালে। টপ্্ ক্লাস বলার অর্থ হল একে তো স্থাপনা সৌন্দর্য ও বিশাল মাঠ, অপর দিকে অসম্ভব মেধাসম্পন্ন একদল শিক্ষক এই স্কুলটাকে শিক্ষার অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। আমার প্রয়াত পিতা ১৯৪১ সালে এই স্কুল থেকে এনট্রেন্স পাস করেন (দশক্লাস)। তারা ১১ জন পরীক্ষার্থী ছিল। ছয় জন পাস করে। টেস্ট পরীক্ষায় বাবা অংকে ৩০ নম্বর পাওয়াতে উনাকে হেডমাস্টার পরীক্ষা দিতে অনুমতি দিতে নারাজ। উনার অংকের টিচার মোহিনী বাবু হেডমাস্টারকে সুপারিশ করেন যে ভালমতে অংকে কোচিং করলে বাবা পাস করবে। অংকের শিক্ষকের নিশ্চয়তায় বাবা পরীক্ষার অনুমতি পান। তখন সব বিষয় ইংরাজীতে পড়তে বাবা সব বিষয় ভাল নম্বর পেতেন। কিন্তু অংকে ছিলেন কাঁচা। ভূগোল আর ইংরাজী ছিল উনার প্রিয় বিষয়। ইংরাজীতে তখন নাকি ছিল আড়াই পেপার। প্রথম পত্র, দ্বিতীয় পত্র এবং ৩য় (ই) পত্র। এই তৃতীয় পত্রে বাবার বর্ষে ছিল Letter from a father to his daughter. ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরু তার কন্যা ইন্দিরাকে বৃটিশ জেল থেকে যে চিঠি লিখতেন ওগুলো ছিল সিলেবাসে। এই থার্ড পেপার অর্থাৎ নেহেরু ইন্দিরার পত্রালাপ বোধ হয় বাবার খুব পছন্দ হতো। পরবর্তীতে তিনি সব সময় আমাকে এই পত্রালাপের বিষয় বলতেন। অংকে বাবা ৩৩ নম্বার পেয়ে পাস করেছিলেন মোহিনী বাবুর অংক শিক্ষায়। মোহিনী বাবুর অংকে ৩৩ অর্থাৎ পাস করার মন্ত্র হচ্ছে–এলজেবরা middle term. পাটিগনিত ঐকিক আর সুদকষা, গসাগু, লসাগু আর সামান্য জ্যামিতি। ইংরাজী Translation এর বাবার ক্লাসের বইটা বেশ মোটা ছিল। আমার ছাত্র জীবনে ও ওটা পড়তাম। অদ্ভুত সব ইডিয়ম, ফ্রেইজ এর ইংরাজী এই স্কুলের ৬৪ পূর্ব অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষাবোর্ড (সারা দেশে এক বোর্ড) এর অধীন পরীক্ষায় বেশ কিছু ছাত্র কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। আবদুল মান্নান সাহেব পঞ্চাশের দশকের শুরুতে অংকে, বিজ্ঞানে কৃতিত্ব দেখান। পরে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতা করেন। চট্টগ্রাম কলেজে অনেক প্রবীণ শিক্ষক ও মান্নান স্যারকে তার পান্ডিত্যের জন্য শ্রদ্ধা করতেন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি কয়েকজন ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এই স্কুলের ৫৪–৫৫ সালের ছাত্র চিত্ত রঞ্জন নাথ সেই সময়েই ডাক্তারীতে ভর্তি হন। উনি এলাকার প্রথম ডাক্তার, চমৎকার হাতের লেখা। এরপর বান্দরবানের সদ্য প্রাক্তন ডিসির পিতা সামসুদ্দিন তিবরীজি অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে করাচী ভার্সিটি থেকে আই–এ, বিএ ও এম এ পাস করেন। এরপর সৈয়দ রেজাউল হায়াত সচিব হন (সিএসপি)। তাদের সময়ের সতীশ চন্দ্র নাথ, প্রিয়দা দাশ (এসডিও) ও তিমির নন্দী তুখোড় ছাত্র ছিলেন। উল্লেখ্য এদের অনেকে চরম দারিদ্রের সাথে (সেই সময়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা) সংগ্রাম করে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৬১ সনে দুজন অসাধারণ ছাত্র কাটিরহাট স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে পাস করেন। একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞানের প্রফেসর মারুফ সাহেব। অন্যজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ও এস.এম হলের ভিপি অধ্যাপক আবু তাহের চৌধুরী। আজকের প্রজন্ম জনাব আবু তাহের সম্বন্ধে বেশী না ও জানতে পারে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছাত্রনেতা। খুব সম্ভব প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেবের একান্ত সচিব ছিলেন। স্বাধীনতার পূর্বে প্ল্যানিং কমিশনে চাকরি করতেন। তিনি কোলকাতার বাংলাদেশ দূতাবাসের অফিসার ছিলেন। তারপর তিনি একান্ত অন্তর্মুখী জীবন যাপন করে সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নেন ও মৃত্যুবরণ করেন।
তার সম্বন্ধে বিশদ বলার কারণ হচ্ছে আওয়ামীলীগের প্রথম সারির নেতাদের থেকেও বঙ্গবন্ধু তাহের সাহেবকে মূল্য দিতেন। রাজ্জাক সাহেব, তোফায়েল সাহেব, মনি সাহেব, সিরাজুল আলম খানদের সাথেই উনার ছাত্র রাজনীতি। মফস্বলের কাটিরহাট থেকে গিয়ে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের ‘বার্ষিকী’ অন্বেষার সম্পাদক হওয়া তৎকালে একটা গৌরবের ব্যাপার ছিল। আমি, বড় ভাই ও মেরিন একাডেমীর প্রাক্তন কমান্ড্যান্ট ক্যাপটেন আজিজ সাহেব তাহের সাহেবের ইংরাজী নোটগুলো পড়তাম। আমার দেখা সর্ববিষয়ে গভীর জ্ঞান ওয়ালা মানুষদের মধ্যে উনি শ্রেষ্ঠ। ঢাকা–চট্টগ্রামে এরকম গভীর জ্ঞান ওয়ালা মানুষ আমি আর দেখিনি।
তখনকার দিনে যারা প্রথম বিভাগে পাস করতেন তাদের নাম পত্রিকায় প্রকাশিত হত। ১৯৬২ সালে কাটিরহাট স্কুল থেকে পাঁচজন প্রথম বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ হলে সারা চট্টগ্রামে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই পাঁচজন কর্মজীবনে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেন। ক্যাপ্টেন আজিজ সাহেব মেরিন একাডেমীর কমান্ড্যান্ট ও উপ–মহাদেশের প্রথম এক্সট্রা মাস্টারস, জনাব বদিউল আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি শেষ করে নোভারটিস এর প্রধান ছিলেন। এডভোকেট কাজী সাইফউদ্দিন একজন প্রথিতযশা উকিল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজীর এম.এ। তিনি আমাকে নবম শ্রেণিতে ইংরাজী পাঠ দেন। আরেকজন প্রকৌশলী আবদুল মাবুদ সাহেব একান্ত মফস্বল স্কুল থেকে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন। ৫ জনের আরেকজন ফেনী কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডের একজন পরীক্ষার্থী জনাব ফরিদ আহমদ বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিএম হন। তিনি বোর্ডে একমাত্র ইতিহাসে সেই আমলে লেটারমার্ক পেয়েছিলেন।
যখন পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ড বিলুপ্ত হয়ে বিভাগীয় শিক্ষা বোর্ড এর অধীনে পরীক্ষা নেয়া হয় তখন প্রায় প্রতি বৎসরই বোর্ডের মেধা তালিকায় এলাকার বহু ছাত্র স্থান অধিকার করে। তম্মধ্যে ১৯৬৬ সনের পরীক্ষায় জনাব খুরশীদ উল আলম ১ম, জনাব একরামুল করিম ১১ তম, কাজী তওহীদুল আলম ২য়, আমি ১৬তম, জনাব মাহফুজ ৬ষ্ঠসহ প্রায় একযুগ নিয়মিত মেধা তালিকায় স্থান পেত।
সময়ের প্রবাহে সব পরিবর্তন হয়। স্কুলের শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষকমন্ডলীরাও পরিবর্তিত, আবার মেধার যুগ পার হয়ে এখন শুধু গ্রেড এর যুগ। এখন অনেকের মধ্যে একজন–অন্যতম বলতে কিছু নেই। এখন সবাই সেবার যুগ। তারপরও কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয় যুগের সাক্ষী হয়ে স্বমহিমায় ভাস্বর।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক