ভূগোলের গোল

সময়ের কথন: ইলিশের শেষ বাজার

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

পঞ্চম শ্রেণির পাঠ শেষে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে হত দূরের কোন স্কুলে যাকে হাইস্কুল বলে। ষাটের দশকে প্রত্যেক গ্রাম বা ইউনিয়নে হাইস্কুল ছিল না, দীঘির পাড়, আমতলাবটতলা স্কুলের প্রাইমারী শেষে হাইস্কুল। কোন কোন স্কুল কোন দুর্গম এলাকার ছাত্রদের জন্য ৬৭ কি.মি.ও হাঁটতে হতো। পঞ্চম শ্রেণি সমাপনী একটা পরীক্ষা হত হাইস্কুলে। এটা এক অভাবনীয় দৃশ্য। ছোট ছোট ছেলে মেয়ে অচেনা এক জায়গায় দু চার গ্রাম থেকে এসে পরীক্ষা দেওয়া। ফাউন্টেন কলমে কালি দিয়ে প্রথম লেখা। হাতেমুখেজামার পকেটে শুধু চুইয়ে পড়া কালি আর কালি। এই কালি সাবানেও যেত না। তরকারীর ঝোলের সাথে লেগে কিছুটা হাত সাফ হতো।

যাহোক ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে নতুন ঝামেলা দেখা দিল। প্রাইমারী স্কুলে বিনা বেতনে পড়ানো হত। হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকেই বেতন দিতে হত। কোন স্কুলে মাসে চারটাকা, কোন স্কুলে মাসে তিনটাকা। গ্রামের অর্ধেক ছেলে ঐ টাকাও দিতে পারত না। তাই স্কুল কমিটি হাফফ্রি, ফুল ফ্রি দিত অভিভাবকের আর্থিক অবস্থা বুঝে। ক্লাসটিচার ১ম পিরিয়ডে মাসে তিনদিন বেতন উসুল করতেন।

আমার বাবা এলাকার গণ্যমান্যদের একজন। স্কুল গভর্নিং বডিরও সদস্য। কিন্তু স্কুলের বেতন দেওয়াতে অনিয়মিত। উনি লন্ড্রী, চা’র দোকান, নাপিত সবখানে মাস কাবারী, বছর কাবারী পয়সা দিতেন। কেউ খুঁজলে আবার পুরোটা দিয়ে দিতেন। ক্লাস টিচার মহেন্দ্র বাবু ১ম পিরিয়ডেই কয়েকজন বাকী বেতন দেওয়া ছাত্রকে দাঁড় করালেন। সবাই ওয়াদা দিলেন অভিভাবককে বলবেন। আমাকে বললেনতোর বাবাকে আমি বাজারে দেখেছি। বেতন নিয়ে আস। আমিও বের হয়ে বাবাকে বললামমহেন্দ্র বাবু বেতন দিইনি বলে বের করে দিয়েছে। বাবা এসে সমস্ত বকেয়া শোধ করলেন। আমার বাবা স্কুল কমিটির তো সদস্য আছেনইএকজন ধনী, প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারপরও মহেন্দ্র বাবু আমাকে বের করে দিলেন ক্লাস থেকে। এটা আজকের বাংলাদেশে চিন্তা করা যায়?

আমাদের স্কুল ও নাজিরহাট কলেজে ক্লাস শুরু হওয়াটা সাড়ে দশটার ট্রেনের সূচীর সাথে যুক্ত ছিল। কারণ আমাদের স্কুলের সুনাম তখন তুঙ্গে। দূর দূরান্ত থেকেও ছাত্ররা ট্রেনে করে আসত। কয়েকজন ছাত্র খোদ চট্টগ্রাম শহর থেকেও আসত। দূরত্ব ২৫ কি.মি: এর মত। স্কুল ছুটি হত সাড়ে চারটায় সব ছাত্র পাঁচটার ট্রেনে বাড়িতে ফেরত যেত।

৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েই বড় ঝামেলায় পড়লাম। কারণ ১৯৩৩ সনে স্কুলটি স্থাপিত হয়। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুরের নানাআবদুল ওয়াদুদ সেরেস্তাদার। আমরা ভর্তি হওয়ার সময় স্কুলের হল ও পাকা ক্লাসরুম তৈরী চলছে। স্কুলে লাস্ট পিরিয়ড ছিল ইট, পাথর টানা, দুইশ ছাত্র লাইন ধরে ফেলত। হাত বদল করে হাজার হাজার ইট ছাত্ররা টেনে ফেলত। ইটগুলো গরুগাড়িতে এনে স্কুলের মাঠের এক কোনায় রাখা হত। লাস্ট পিরিয়ডে আমাদেরকে দিয়ে টানা হত। উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের দিয়ে ইট টানাতে দেখিনি। শীতের দিনে পাঁচটা মানে সন্ধ্যা। তার উপর দিগন্তে নেমে আসা কুয়াশা। গ্রামীণ পথে এই ছাত্ররা ৫৭ কিমি পথ হেঁটে কখন বাড়ি যেত, কখন হোমওয়ার্ক করত এটা আমার কাছে এখনো একটা তাজ্জব ঘটনা মনে হয়। আমার বাড়ি ২ কি.মি। বিজয় মেলার হাশেম ভাই, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মঈনউদ্দিন ভাইদের বাড়ি ৫৭ কিমি ওয়ান ওয়ে। বর্ষা বাদলের দিনে কিভাবে আসাযাওয়া হত এটা আজকালকার টেম্পুটেক্সীর যুগে কল্পনাতীত।

এলাকার হাট ছিল শুক্র আর মংগলবার। এখনকার মত প্রতিদিন বাজার বসত না। সাপ্তাহিক বন্ধ ছিল রোববার। বিকাল সাড়ে তিনটার ট্রেনে শহর থেকে বরফের মাছ আসত। পশ্চিমের বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে পাহাড়ের সরু মাটির রাস্তা ধরে ১০১২ কি.মি. পথ বেয়ে লইট্টা মাছ কাঁধে বয়ে কিভাবে আনত এটাও আজকের বাস্তবতায় বোঝা দুরূহ। শহর থেকে আসা বরফের মাছ মানেই ইলিশ মাছ। তখনো ‘মাছের রাজা ইলিশ’ এরকম স্লোগানের বালাই ছিল না। ইলিশের মৌসুম আসলেই আমার উপর মা’র তরফে ‘উপরি আবদার’ নাজিল হত। বিকেল চারটায় বড় ইলিশ কিনে মার হাতে দিতাম। ২ কেজির বেশি বরাবর। বাড়ির আঙ্গিনাতে সত্যিই ইলিশ রান্নার দারুণ খুশব ছড়িয়ে পড়ত। সমস্যা হল সন্ধ্যার পর মা আমাকে আবার বাজারে পাঠাতেন। স্কুলে যাওয়া আসা ৪ কি.মি. সন্ধ্যায় আবার হাটে যাওয়া আসা আরো ৪ কি.মি.। ৬ষ্ঠ শ্রেণির একটা বাচ্চা এই ধকল কিভাবে সহ্য করতাম তা খোদাই জানেন। সন্ধ্যার পর আবার হাটে যাওয়ার ‘মরতবা’ হল “আইল হাটা” (Early shopping) ইলিশের কেজি দেড় টাকা হলে মাগরিবের পর তা ১ টাকার নিচে আটআনাবারো আনায় নেমে আসত। মা বলতেন-‘যুৎ’ মতো দাম হলে ২টা কিনতে। এই মাছ পরিষ্কার করে রান্না করে শুকিয়ে রাখতে (ফ্রীজ আসে গ্রামে আরো ৪০ বছর পরে) রাত ১০টা। হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে প্রথম একটা ‘গণপিটুনি খেলাম’ এক হুজুরের হাতে। হুজুর ছিলেন ‘কওমী’ লাইনের ওরশবিরোধী। ছাত্ররা সবাই ছিলাম ওরশ পাগল। হুজুর মাইজভাণ্ডারের ওরশের আগে এত বেশি বাড়ির কাজ দিতেন যেন আমরা শেষ করতে না পারি। কারণ হুজুর জানেন যে অর্ধেক ছাত্র রাতে ওরশে থাকব। সারা রাত না ঘুমায়ে আধাক্লান্ত নয়নে যখন হুজুরের ক্লাসে থাকতাম হুজুর বাড়ির কাজ চাইতেন। অগ্নিশর্মা হয়ে বলতেনবেদাতী সব! ওরশে গেছিলি। পুরোদমে বেতের কসরত চালাতেন গোটা ক্লাসের উপর। আজকালকার দিনে সবাই নিজ ‘তরীকায়’ গোঁড়া। মিছিল করে হয়ত হুযুরের বদলী চাইত। গুজরা হুয়া জমানাআয়েগা নেহি ফের! সে সময় গত, তা আর আসবে না। অতীত থেকে প্রজন্ম শেখে, অতীতের সময়ের যাত্রীরাও হারিয়ে যায়। রয়ে যায় শুধু সময়ের কথন!

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধডেঙ্গু প্রতিরোধে যত্নশীল হতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধবুড়িশ্চর জিয়াউল উলুম কামিল মাদ্রাসার সবকদান অনুষ্ঠান