বাংলাদেশে ১৯৭১ এর স্বাধীনতার আগে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুরে বেশ বড় উর্দুভাষী শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছিল। এদের অনেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান বাস করত। তারা সবাই উত্তর ভারত ও দক্ষিণে হায়দ্রাবাদের থেকে শরণার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে বসতি করে। এই তিন শহরে দশম শ্রেণি
পর্যন্ত উর্দুভাষী স্কুলে পড়াশোনা করতে পারত। তাদের সুবাদে উর্দু কথা কানে বাজতো। বাংলার সঙ্গে অনেক শব্দ মিল থাকলেও বেশি কথাই বুঝতাম না। উর্দু ভাষা যে একটা সাহিত্যচর্চারও ভাষা তা বুঝেছি অনেক পরে।
আমাদের দেশে মানুষ হিন্দি ভাষার সাথে যেমন পরিচয় লাভ করেছে হিন্দি ফিল্ম এর মাধ্যমে তেমনি অনেকের উর্দু ভাষার সাথেও পরিচয় ‘গজল’ সংগীতের মাধ্যমে, এদেশে গজল ও জগজিৎ, চিত্রা, মেহেদী হাসান, গোলাম আলী, তালাত মাহমুদ, সুপ্রিয়া যোশী ইত্যাদির নাম সমার্থক। কিন্তু ভারতে বিভিন্ন ডাক্তারি কনফারেন্সে গিয়ে দেখি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ‘শের’ বলে। শের হচ্ছে ক্ষুদ্র কবিতার পংক্তি গুচ্ছ-যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অর্থবহ, আনন্দ, প্রজ্ঞা, উচ্ছ্বাস সবই থাকে এই শেরগুলোতে।
উত্তর ভারতের লক্ষ্ণৌ, এলাহাবাদ, কানপুর, দিল্লি, আগ্রাসহ অনেক শহরে বিয়ে-শাদী হোক বা অন্য কোন সমাবেশ হোক ‘শের’গজল, কাওয়ালী, থাকবেই থাকবে। একবার ভারতের পাঞ্জাবের জলন্ধরে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ক্যান্টনমেন্টের ভেতর, এক ঘন্টা কাওয়ালি পরিবেশন করা হয়, সমস্ত শিখ সেনা অফিসাররা হাততালি দিয়ে কাওয়ালী উপভোগ করল।
আওরঙ্গবাদ নামে মহারাষ্ট্রে একটা শহর আছে। এটা মুম্বাই থেকে ৫০০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে। হাঁপানির এক অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তৃতায় সভাপতি এক‘শের’ দিয়ে শেষ করলেন।
যখন কেউ কিছু লিখে
যার কিছু আমরা বুঝি
আর কিছু বুঝিনা
তাকে কবিতা বলে।
যখন দুই তরুণ-তরুণী
যা কথা বলে শুধু
ওরা দুজনেই বোঝে,তাকে প্রেম বলে,
বল যখন কোন রোগের কিছুই বুঝিনা তাকে এলার্জি বলতা হ্যায় ।
সবাই তুমুল করতালি দিল (হাঁপানি মূলত এলার্জি রোগ।)
লক্ষ্ণৌ হল বর্তমানে ‘শের’ ও গজল এর তীর্থভূমি, গানের অনুষ্ঠানে দেখলাম ডাক্তার, প্রফেসর, মন্ত্রী, আমলা, হিন্দু-মুসলিম সবাই শুধু শের আওড়ায়।
‘শের’ হল উর্দু সাহিত্যের ও দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য। মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘শের’ এর বিস্তৃতি হলে ও এখন একেবারে শের মানুষের ড্রইং রুমে ঢুকে পড়েছে। ব্রিটিশরা মূলত উর্দু সাহিত্যকে ভারতে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। বর্তমানে ভারত পাকিস্তানের পাঁচজন ‘গজল’ ও শের রচিয়তা কে উর্দুভাষীরা বিশেষ সমাদর করেন। তারা হলেন মীরতকি, গালিব, মীর আনিস, ইকবাল, জোশ মালিহাবাদি প্রমুখ। ১৯৪৭ সালে উর্দু সাহিত্যের প্রাণ-পুরুষরাও পাকিস্তান ও ভারতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এই শেররচয়িতারা ফার্সি কবি রুমি, হাফিজ, গাযযালী দ্বারা সবিশেষ প্রভাবিত হন। আমির খসরু সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীকে সারারাত ‘শের’ ও গজল শুনাতেন। শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ বহুমূল্যবান শের ও গজল লিখে গিয়েছেন। তাকে বার্মার রেঙ্গুনে মাটির ঘরে ব্রিটিশরা বন্দি করে রেখেছিল। তিনি গজল লেখার জন্য কাগজ-কলম চাইলেন ব্রিটিশরা তাকে কাগজ কলম দিলেন না। সম্রাট বাহাদুর শাহ পুরো ঘরের দেওয়ালে ‘শের’ লিখে ভরিয়ে ফেললেন। মাত্র দুই লাইন ‘শের’ এই বাদশার সমস্ত কীর্তি ও অস্তিত্বকে অমর করে রেখেছে:
কত বদনসীব জাফর তুমি,
যে জমির সাথে এত মমত্ব ছিল,
দাফনের জন্য তাতে দুই গজ
জায়গা মিলল না।
যে কারণে আজকে ‘শের’ সম্বন্ধে লেখা তা হল মানুষের জীবনের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে ভারত পাকিস্তানে বিস্তর লেখা হয়েছে ও হচ্ছে। করোনার দুই বছরের বন্দিজীবন মানুষের অন্তর্মুখী ও আবেগে যে তোলপাড় করেছে এসব ‘শের’ এ তার প্রতিফলন ঘটেছে।
ভারতের মুম্বাইয়ের আণবিক শক্তি কমিশনের একজন বড় বৈজ্ঞানিক জে.ভি ইয়াখমি ‘শের’এর একজন বড় ভক্ত। তিনি করোনার সময়ে একগুচ্ছ ‘শের’ লিখেন। এতে মানুষের মনের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। করোনাকে নিয়ে লেখা একটি ‘শের’
নিজের ঘরে বন্দী হয়ে রইলাম
এই হালে দিন মাস যাচ্ছে ,
একটি ছোট্ট কণা (জীবাণু)র
কাছে আজ সবাই পরাজিত।
অবসর প্রাপ্ত বয়স্কদের দিন করোনাই কেমন কাটছে?
অবসরে গেছি সবাই এটা সত্যি,
কিন্তু কিছু অনেক (জোক) তো বলা যায়,
কিছু হাসির কথা তো বলা যায়,
মোবাইলে তো কিছু কথা বলা যায়,
করোনাকালে মোবাইল মানুষের কত সঙ্গ দিয়েছে তার একটি ‘শের’
ফোনপর হি সহি ,
সাথউনকো রহে।
কুচকহো,
কুচশুনো,
গুন গুনাতে রহো।
অর্থাৎ-ফোনালাপই ঠিক আছে, মোবাইলের সাথেই থাকো, কিছু বল, কিছু শোন-গুনগুন করতেই থাকো।
হিন্দি ফিল্ম উমরাও জান, মোগলই আজম-ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে গজল বান্ধব করেছে। নিদাফজলী একজন ভারতীয় উর্দু কবি, ২০১৩ সালে এই উর্দু কবি পদ্মশ্রী উপাধি লাভ করেন। তার একটি বিখ্যাত ‘শের’ গান করেছেন ভূপিন্দর সিং। মানব মনের একটি শাশ্বত হাহাকার কবি এভাবে উচ্চারণ করেছেন;
কভি কিসিকো মোকাম্মেল
জাহা নেহি মিলতা,
কাহি জমিন তো কাহি
আসমান নেহি মিলতা।
অর্থাৎ পরিপূর্ণ সুখ এই পৃথিবীতে তো মিলে না আকাশে গেলে ও মিলবে না।
উর্দুভাষীদের জন্য এ ‘শের’ এর আসর বা ‘মুশায়ারা’এক অনির্বচনীয় আনন্দের মুহূর্ত। এগুলো এত হৃদয় নিঃসরিত, এত জ্ঞান গর্ভ যে-মানুষ সত্যিই এগুলো শুনে শুনে রাত কাটিয়ে দেয়। আমাদের যেমন ভাষার গর্ভ কবিতা, ইংরেজদের যেমন ‘সনেট’-পারস্য দেশ যেমন রুবাইয়্যাত তেমন উর্দুভাষীদের এই ‘শের’।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক