১৯৪৭ সালে ভারত–পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সময় ভারতে ডজন খানেক বুঝনে ওয়ালা নেতা ছিলেন। নেহেরু–প্যাটেনের সমান মাথাওয়ালা কামরাজ, বেনু গোপাল, মৌলানা আজাদ, শেখ আবদুল্লাহ প্রমুখ ‘ইন্টিগ্রিটি’ ওয়ালা নেতা ছিলেন। তার বিপরীতে পাকিস্তানে লেয়াকত–জিন্নাহ ছাড়া মাথাওয়ালা নেতা কম ছিলেন। পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য যে, এই দুজনই ৪৭ পরবর্তী চার বছরের মধ্যে মারা যান। নামী রাজনীতিবিদ পূর্ব বাংলার সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক ভাসানী বা পশ্চিম পাকিস্তানের জি.এম সাঈদ (সিন্ধু) বা ওয়ালীখান (বাসুচ) এর মত নেতাদেরকে শাসন বৃত্তের বাইরে রাখার জন্য লেয়াকত পরবর্তী পাকিস্তানিরা হুলিয়া, জেল জুলুমের নীতি গ্রহণ করে। ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট রাজনীতির প্রাক্কালে পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল তরুণ নেতৃত্বের উত্থানের এক সুযোগ সৃষ্টি করে। এই সুযোগেই রাজনীতির সম্মুখ সারিতে চলে আসেন–তরুণ বঙ্গবন্ধু। উনি ভাটি বাংলায় দিন রাত যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী সভায় ভাষণ দিতেন। যেহেতু তিনজন বড় নেতা সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ও ভাসানী জনতাকে উদ্দীপ্ত করার মত ভাষা ব্যবহার কম করতে পারতেন সেখানে বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী বক্তৃতা জনতাকে উদ্দীপ্ত করত। নৌকা–লঞ্চে ভাটি বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেছেন। (সূত্র: সাংবাদিক ওবাইদুল হক এর রচনা)
১৯৪৭ থেকে ৫৭ এই দশ বছর পূর্ব বাংলায় প্রকৃত অর্থে কোনো উন্নয়নই হয়নি। চট্টগ্রাম শহরে ১৯৪৭ পরবর্তী ১০ বছরে একটা তিন তলা বিল্ডিংও হয়নি। অপর পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানে এই দশ বছরে একটা দারুণ যোগাযোগ ও শিল্প অবকাঠামো গড়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার নিত্য ভংগুর রাজনৈতিক সমঝোতা ও নেতাদের অন্তর্কলহ ও অনগ্রসরতার জন্য কম দায়ী না। অবস্থা এমন হাস্যস্পদ ছিল যে সকালে এক মন্ত্রী সভা শপথ নেয় তো পরের সপ্তায় তা কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ‘ডিস্মিস’। আবার পূর্ব বাংলার কেউ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে করাচী থেকে শপথ নিয়ে ঢাকায় অবতরণ করে জানতে পারে যে তার মন্ত্রিত্ব খারিজ। রাজনীতির এমন বেহাল অবস্থায় জনগণেরও অবস্থা দিশাহীন হয়ে ওঠে।
এমন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী হয়। মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারের মীর্জা ইসকান্দরকে সরিয়ে আইয়ুব খান গদী দখল করে। ইসকান্দর মীর্জাকে জোর করে প্লেনে তুলে লন্ডন পাঠিয়ে দেয়া হয়। লন্ডনে পাকিস্তানের এই প্রেসিডেন্ট একটা রেস্টুরেন্ট এর দোকান দেন। লন্ডনে তখন আজকালকার মত ফ্রি চিকিৎসা সেবা ছিল না। অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মৃত্যুবরণ করেন। তার মরদেহ পাকিস্তানে দাফন করতে চাইলে আইয়ুব খান অনুমতি দেয়নি। ইসকান্দর মীর্জার পরিবার ঢাকায় দাফন করতে চাইলে আইয়ুব খান তার ও অনুমতি দেয়নি। এমতাবস্থায় ইরানের শাহ সমস্ত খরচ বহন করে মরদেহ তেহরানে এনে রাজকীয় সম্মানে দাফন করেন।
পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসন আইয়ুব খানের। সামরিক শাসনের শুরুতে সচরাচর যে রকম হয়– চারদিকে নেতা, মুনাফাখোর, মজুতদার সবাইকে জেল দেয়া শুরু হয়। বেসামরিক প্রশাসনের ব্যর্থতার ফলে যে সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টি হয় সামরিক শাসকদের বড় পুজি হচ্ছে “জনতার অসন্তোষ”। মানুষ সমাজের অনকাঙ্ক্ষিত দুষ্টু লোকগুলোকে মিলিটারি জেলে পুরছে দেখে তাদের সমর্থন করা শুরু করে। অনেকটা মন্দের ভালোর মত। মিলিটারি প্রথমে মজুতকারীদের ধরা শুরু করে। বড় বড় শহরের কেন্দ্রে (চট্টগ্রামে লালদীঘি) মাঠে বিভিন্ন অপরাধীদের বেত্রাঘাত থেকে শুরু করে সব শাস্তি দেয়া হত জনসমক্ষে। অনেককে ফায়ারিং স্কোয়ার্ডের শাস্তিও দেয়া হয়। এক মজুতদার চিনি মজুত করে মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে। ভয়ে সে সব চিনির বস্তা চকবাজার এলাকার একটা পুকুরে ফেলে দেয়। পুকুরে তাকে ডুব মেরে বস্তা তোলা হয়। পরে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। ভদ্রলোক আমার এলাকার। তার লাশবাহী গাড়ি অনেক বাচ্চাদের সাথে দূর থেকে আমিও দেখেছি। মিলিটারির সেই শাস্তি আমার স্মৃতি থেকে এখনো মুছেনি।
গ্রামগঞ্জ তখন ডোবা আর কচুরীপানায় ভরা। স্কুল–কলেজের মাঠ আগাছায় (বাঢইয়া–মায়াকাটা) ভরা থাকত। প্রকট ম্যালেরিয়ার প্রধান উৎস মশার আইডিয়াল প্রজনন কেন্দ্র কচুরীপানা, ডোবা, আগাছা। মিলিটারির ভয়ে ছেলে–বুড়ো সবাই নিজ নিজ এলাকা পরিচ্ছন্নতার কাজে লেগে গিয়েছিল। আইয়ুব মন্ত্রীসভার অধিকাংশ সদস্য ছিল ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসার। চতুর আইয়ুব সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর বড় কর্তাদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। তাদের সমবেত ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডার বের করেছিল। জেনারেল আযম খান, মেজর জেনারেল উমরাও খান, এয়ার ভাইসমার্শাল আসগর খান–প্রমুখ স্মার্ট মন্ত্রীর নাম খবরে আসত নিয়মিত। আযম খান পূর্ব বাংলার গভর্নর হয়ে বাঙালীদের সুখে দুঃখে সমস্যার সমাধান করতেন বলে এই পাকিস্তানি বাঙালীদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিল। পরবর্তী গভর্নর আযম খান দেওয়ানহাট রেলক্রসিং এ আটকা পড়লে এয়ার পোর্টে দেরিতে পৌঁছান। সাথে সাথে ছয়মাস সময়ের মধ্যে দেওয়ানহাট ওভারব্রীজ নির্মিত হয়। আইয়ুব খানের রাজনৈতিক মতলব ভাল ছিল না। কিন্তু দশ বছরে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের অবসানে পূর্ব বাংলায় বেশ কিছু বড় শিল্প অবকাঠামো তৈরি করেন। রিফাইনারী, স্টীল মিল, মংলা বন্দর, প্রগতি গাড়ির কারখানা, কাপ্তাই বিদ্যুত কেন্দ্র ইত্যাদি আইয়ুব খানের শাসনকালে পোক্ত হয়ে উৎপাদনে যায়। উন্নয়ন যত দ্রুত হয়েছিল আইয়ুব আমলে গণতন্ত্রের অবস্থা ততই দ্রুত অবনতির দিকে যায়। আইয়ুব খান ঘটা করে ১৯৬৮ সালে ‘উন্নয়নের এক দশক’ পালন করে। ১৯৬৯ সালেই তার পতন হয়।
১৯৬০–৬৫ সাল নাগাদ পূর্ব বাংলার অর্থনীতি ভারতের কয়েকটি রাজ্য থেকে মজবুত তো ছিলই বরং মালয়েশিয়া, ব্রাজিলের সমমানের ছিল গড় আয়। সে সময় সার্কিট হাউজে আইয়ুব খান উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে পাকিস্তান যে ভারত থেকে উন্নত অর্থনীতি তার বিবরণ দেন সাংবাদিকদের। তরুণ সাংবাদিক মঈনুল আলম সাহেব (কানাডায় মৃত্যু) দাঁড়িয়ে বললেন–মিঃ প্রেসিডেন্ট! পাকিস্তানে সত্যিই অনেক কিছু আছে যা ভারতে নেই। কিন্তু ভারতে একটি জিনিস আছে যা পাকিস্তানে নেই–আর তা হল গণতন্ত্র। আইয়ুব নীরব থাকেন।
আইয়ুব আমলে আবারো দেশজুড়ে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে প্রধান বক্তা রূপে দেশ চষে বেড়ান বঙ্গবন্ধু। গ্রামের বুড়োরা সেই সময় থেকে একটা কথা ছড়িয়ে দেন-“মুজিবের ভাষণ, আইয়ুবের শাসন”। সময়ের আবহে আইয়ুবের পতন হয়। ইতিহাসের কথন ছাড়া উন্নয়নের নায়ক আইয়ুবের উল্লেখ হয় না। কিন্তু মুজিবের ভাষণ পরবর্তীতে ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ’ হয়ে অমর উপাখ্যান সৃষ্টি হয়। শুধু ৭ ই মার্চের ভাষণ নয় রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের সামনে তিনি দিক নির্দেশনা ও দায়িত্ব, কর্তব্য বিষয়ক যে ভাষণগুলো দিয়েছেন তা সমাজের আজকের দিনে বহুল প্রচারও বোধন জরুরি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক।