ভূগোলের গোল

ডা: কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ৩ অক্টোবর, ২০২৩ at ৪:৩৮ পূর্বাহ্ণ

সময়ের কথন : বসন্ত মাস্টার

দশ বছর আগে বাংলাদেশ সচিবালয়ে সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের শিক্ষাগত ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে একটা সমীক্ষা হয়েছিল। তাতে শতকরা ৯৭ জনই গ্রামের প্রাইমারী, হাইস্কুলে শিক্ষা লাভ করে দেশের উচ্চপদে আসীন হয়েছেন বলে তথ্য দেন। এসব কর্মকর্তাদের অধিকাংশই গ্রাম বাংলার সাধারণ পরিবারের সন্তান। ভাগ্যের চক্র ঘুরতে ঘুরতে এরা ধনবাদী সমাজে ডিক্লাসড হয়ে (শ্রেণি চ্যুতি) নতুন এলিট শ্রেণিতে পরিণত হয়। সমাজের সর্বক্ষেত্রে একটা অসামঞ্জস্য আজকের সমাজের বাস্তবতা।

আমরাও ছোটকালে বাড়ির কাছের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পড়তাম। কেজি, কেজি২ নার্সারীপ্রথম শ্রেণির আগে এত সোপানের বালাই ছিল না। প্রথমেই শুরু শিশু শ্রেণি নামের একটা স্তর থেকে। অক্ষর শেখা, লেখা, বানান, ছড়া সব মুখে মুখে। অনেকটা কোরাসের সুরে। খারাপ ছাত্ররাও মনের খুশীতে অক্ষর বানান শিখে ফেলত। প্রথম শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণীত বই ছিল। বইগুলোর সিলেবাস বেশ উপভোগ্য ছিল। ইংরেজী শিক্ষা শুরু হত ক্লাস ফোর থেকে। তার আগে শুধু বড় হাতের ও ছোট হাতের ইংরেজী অক্ষর লেখা। অনেক ছাত্র স্কুলের সরকারী নাম জানত না। ছাত্রঅভিভাবক সবাই বাচ্চা কোন স্কুলে পড়ে? তার জবাবে বলত দীঘির পাড়ে, নদীরঘাটে, চাইল্যাতল, কলঘরের পাশে ইত্যাদি। এটাও এক আজব ব্যাপার ছিল। প্রত্যেক স্কুলে পাঁচ জনের বেশী শিক্ষক ছিল না। দু একজন টাইমমত আসলেও বাকীরা টাইম মত আসতেন না। অনেক টিচার সকালের চাষ, গরুকে খাওয়ানো, গোসল দেয়া ইত্যাদি গৃহস্থালী কাজ সেরে স্কুলে আসতেন। সেই স্কুল পড়ুয়া ছাত্ররা পরবর্তীতে হাই স্কুল, কলেজে গিয়ে কিভাবে যে ‘ভাল শিক্ষা’ পেত তা আমার কাছে এখনো একটা “মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন”।

শিশু শ্রেণিতে যাওয়ার আগেই অর্থাৎ ৪৫ বৎসর বয়সেই মাবাবারা ঘরে ‘বাল্য শিক্ষা’ বই পড়াতেন। বাল্য শিক্ষা ছিল দুই রকম। ‘মুসলমান বাল্য শিক্ষা’, আর রাম সুন্দর বসাক বাল্য শিক্ষা। মুসলমান বাল্য শিক্ষার বানান পদ্ধতি সহজ ছিল। ওটাতে কিছু ইসলামী কথাবার্তা ছিল। মাসের নামগুলোর সাথে ইসলামী ক্যালেন্ডারের নামগুলোও শিখানো হত। কিছু কিছু দুই চার লাইনের ছন্দযুক্ত ছড়া থাকত যার ভাব ও বিষয়বস্তুও ইসলামিক ইতিহাস থেকে নেয়া। অপরপক্ষে রামসুন্দর বসাকের বাল্য শিক্ষা রীতিমত কঠিন তো শুধু নয়মহা কঠিন। রামসুন্দর বসাকের বাল্য শিক্ষায় শ্লোকগুলো সংস্কৃত শব্দে ভরপুর। কোমলমতি শিশুরা তার কতটুকু বুঝত কে জানে। আর যুক্ত বর্ণের উদাহরণ সম্বলিত শব্দগুলো শিশুর বোধের সীমার বাইরে ছিল বলে মনে হয়। একটা শ্লোক আমার এখনো মনে আছে

দুষ্টমতি লংকাপতি, হরে নিল সীতাসতী

রামচন্দ্র গুণধর, ত্বরা গিয়ে সিন্ধু পার।

বলা হয়ে থাকেযারা রামসুন্দর বসাকের বাল্য শিক্ষা পড়ে তারা বিএ ক্লাসের বাংলা বইও পড়তে পারে।

খাতাকলমের ব্যবহার শুরু হতো ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে। প্রাইমারী স্কুলে লেখার মাধ্যম ছিল কলাপাতা আর শ্লেট। হোম ওয়ার্ক আনতে হতো কলাপাতায় লিখে। লিখার কালি বানানো হতো পাতার রস নিংড়ে। বাঁশের সরু কঞ্চি দিয়ে কলম বানানো হত। কালিতে কঞ্চি ডুবায়ে ‘বাড়ির কাজ’ লিখা হত। এত কষ্টের আয়োজন ক্লাস শিক্ষক দেখে একজনকে বলতফেলে দিয়ে আয়। পুরো ক্লাসের কলাপাতার ‘হোম ওয়ার্ক’ পাশের কোন পুকুর বা ডোবায় ফেলা হত না; কারণ পায়ের নীচে হস্তলিপি পড়লে অপয়া হয়।

ক্লাস থ্রি পর্যন্ত অংকে দশ নম্বর থাকত ‘মানসাংক’ পার্টে। এই অংক পদ্ধতি সত্যিই কঠিন ও অবৈজ্ঞানিক। এখন প্রাইমারী স্কুলে হাটবাজারে বাজার করতে যাওয়া বা মাঠে কৃষি কাজে যাওয়া ১২১৪ বছরের ছেলেগুলো ও থ্রিফোরে পড়ত। ওদের পক্ষে মানসাংকের জবাব দেয়া খুব সোজা ছিল। আমরা ছোটরা মানসাংক বুঝতামও না জবাবও দিতে পারতাম না। যেমন টিচার প্রশ্ন করতেন এক সের ডাল আট আনা হলে এক পোয়ার দাম কত? এক ডজন ডিম এক টাকা হলে এক হালি (চারটার) দাম কত? সেরছটাকই বুঝতাম না উত্তর দেব কি? বয়স্ক ছাত্রগুলো পটাপট উত্তর দিত। চতুর্থপঞ্চম শ্রেণির বইগুলো হাই স্কুলের প্রস্তুতিমূলক সিলেবাসে ভরা ছিল। বাংলা শব্দার্থ, ইংরেজি ওয়ার্ডইত্যাদি। আমার সমস্যা হত ফুলকপি, বাধাকপি, মূলা ইত্যাদির ইংরেজী ওয়ার্ড শিখতে। হাটবাজারের তরকারীর ইংরেজী নাম কি দরকার ওটাই বুঝতাম না। এই দীঘির পাড়, বাঁশতলার প্রাইমারী স্কুলগুলোর একটা বড় পজিটিভ দিক হল বৃহস্পতিবারের অর্থাৎ ছুটির আগের দিনের পড়ার ক্লাস। সপ্তাহের এই শেষ দিনে পুরোনো পড়াগুলোর উপর পরীক্ষা নিয়ে ‘জ্ঞান’ পোক্ত করে নেয়া হত।

৪র্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা ও অংক পড়াতেন বসন্ত মাস্টার, বয়স্ক ভদ্রলোক চশমা ও ধুতি পরতেন। মেট্রিক পাস করেননি। লঘিষ্ট, গরিষ্ট ইত্যাদি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতিতে শিখাতেন। বসন্তবাবু ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের কোচিং নিতেন। বাংলা গদ্যপদ্য যা পড়াতেন তার রচয়িতা অর্থাৎ কবি ও প্রাবন্ধিকের নাম, জন্ম, তার বাপদাদার ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে ক্লাস শেষ করতেন। গ্রামের ছেলেরা কোথায় বিদ্যাসাগর, কোথায় রবীন্দ্রনাথ, কোথায় মেদীনীপুর বা জোড়াসাকোঁ ইত্যাদি নিয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহও দেখাতো না মনে ও রাখত না। বসন্ত বাবুর ক্লাস পর্যন্ত। একদিন বসন্ত মাস্টার কি একটা কবিতা পড়াচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথের। ওখানে ‘জলৌকা’ নামের এক শব্দের অর্থ বোঝাতে গিয়ে খুব ধমক ছিলেন সবাইকে। বললেনগরুর গোস্ত কম কিনে বাবাকে বলবি ‘অভিধান’ কিনতে। ‘অভিধান’ থাকলে জলৌকার অর্থ বুঝতি! আমরা ৩য়৪র্থ শ্রেণির গ্রামের ছাত্র। ডিকশেনারীর নাম শোনা মুরু করেছি। কিন্তু ‘অভিধান’ কী চীজ এটা বুঝেছি আরো দশ বছর পর। গরুর গোস্ত নিয়ে স্যারের বক্তব্যকে ও ছাত্রঅভিভাবক কোন ‘সাম্প্রদায়িক’ বক্তব্য মনে করেনি। বসন্ত বাবুকে অভিভাবকরা ডানপিটে ছাত্রদেরকে ধরে এনে বলতেনপিঠের চামড়া তুলে ফেলবেন মাস্টার বাবু। আপনার জিন্মায় দিলাম। আমার জন্য শুধু হাড্ডি রাখলেই চলবে। বসন্ত মাস্টার অভিভাবকদের কথা রেখেছেন ‘মাইর’ খেয়ে যাতে পিছু না হটে তার জন্য দুইজন তাগড়া যুবক পিছনে ধরত, আর বসন্ত মাস্টার বেতের কসরত চালাতেন বেচারা ছাত্রের উপর। অনেক ‘ড্রপ আউট’ হত শুধু বসন্ত মাস্টারের ‘মাইরের ভয়ে’।

আইয়ুব খানের মার্শাল লর মধ্যে একটা বড় প্রকল্প ছিল সার্বজনীন টীকা দান কর্মসূচি। তখন বোধ হয় শধু যক্ষ্মা ও গুটি বসন্তের টীকা দেওয়া হত স্কুলে গিয়ে। টীকা ওয়ালা আসার খবর পেলে সমস্ত বাচ্চা যে যেদিকে পারে পালিয়ে যেত। দুইচারজন অভিভাবক বাচ্চাদের বাড়ি থেকে ধরে এনে টীকা দেওয়াত।

সময় বয়ে যায়, বসন্ত মাস্টারেরও জীবন প্রৌঢ় সময়ে। ১৯৭১ এর সেই বীভৎস ঊীড়ফঁং (দেশত্যাগ) এ চৈত্রের তীব্র তাপদাহে একটা ছাতা মাথায় ও হাতে একটা জীর্ণ লন্ঠন নিয়ে বসন্ত মাস্টারকে নির্লিপ্ত পদে হাঁটতে দেখলাম। একটা হয়ত জোয়ানরা এই বৃদ্ধকে প্রকৃতির কাছেই ছেড়ে অগ্রসর মান। আমরা দুতিনজন পা ধরে প্রণাম করলাম। মাস্টার মশাই নির্বাক অমানিশার অনন্ত যাত্রায় পুরোনো লন্ঠন হয়ত পথ দেখাবে। বিধ্বস্ত নীলিমার প্রান্ত পানে ধীরে পায়ে চলতেই থাকলেন বসন্ত মাস্টার। সময়ের কথনে কত ঘটনা, কত চরিত্র। মাস্টার মশাইয়ের ‘জলৌকা’ আর ‘অভিধানের’ কথন জীবনস্রোতে অন্ত যাত্রায় সুর মূর্ছনায় বাজতেই থাকবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিষয় যখন নারী
পরবর্তী নিবন্ধরাসায়নিক শিল্পপার্ক ও প্লাস্টিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে