করাচী–পেশোয়ারে নতুন জীবিকার সন্ধান পেয়ে আমার এলাকার বার্মা–পরবর্তী প্রজন্ম কিছুটা স্বস্তি অনুভব করে। এই স্বস্তি ১৯৭১ পর্যন্ত মোটামুটি শেষ হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানে জীবিকার সন্ধানে গিয়ে বাংগালী তরুণদের প্রথম সমস্যা হতো একটা সম্পূর্ণ পরিবেশ ভাষা। খাদ্য কিছুই তাদের পরিচিত না। সর্বোপরি স্থানীয় পাকিস্তানীদের বেশীরভাগ লোক বিশেষতঃ পাঞ্জাবিরা আমাদের লোকদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করত।
যারা প্রতিরক্ষার বাইরে চাকরী করত তারা ‘বাংগালী’ ক্ষুদে মেস্ করে থাকত। এসব মেসে বাংগালী কায়দায় রান্না হত। তেমন খারাপ লাগত না বিদেশ বিভুইয়ে। সবচেয়ে ‘হোম–সিক’ হয়ে যেত যারা প্রতিরক্ষাবাহিনীতে চাকরি করত তারা। এদের অধিকাংশই মেট্রিক, আইএ পাস তরুণ। এরা নিতান্তই গ্রাম–বাংলার সন্তান। তাদের সকালের নাস্তাও হত ভাত দিয়ে। এখনো গ্রামে রুটি, পাউরুটি, পরোটার চল হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানে যারা প্রতিরক্ষা বাহিনীর চাকরি করত তাদের সমস্যা হত সকালের নাস্তা, রাতের রুটী। রাতে পাকিস্তানীরা ‘ভাত’ খায়না। রুটীই তাদের রাতের খাদ্য। ফলে এসব বাংগালী যুবকরা খাওয়া দাওয়ায় ‘যুৎ পেত না। অনেকে আপেল আংগুর খেয়ে দিন কাটাত।
আশির দশকে বাংলাদেশ–ভারত পর্যটকদের মধ্যে যেমন বিদেশী সিগারেট, বিদেশী মদ নিয়ে কোলকাতা যাওয়ার প্রবণতা ছিল (ভারত এখনো বিদেশী মদ সিগারেটের দুষ্প্রাপ্য ছিল এবং কোলকাতা থেকে বাংলাদেশ আসার সময় শাড়ী, থ্রি–পিচ এর আমদানী হত তেমনি দুই পাকিস্তানের মধ্যে বেশ কিছু ‘গ্রেট ডিমান্ডের’ আন্তঃ বাণিজ্য ছিল। চট্টগ্রাম থেকে ‘পানির জাহাজে’ যারা করাচী যেত ওরা লাগেজ ভর্তি পান–সুপারী, লুংগী, আম–কাঠাল, কলা নিয়ে যেত। পানগুলো মহেষখালী–টেকনাফ অঞ্চলের । পাকিস্তানে পান হয় না। কিন্তু তারা কিভাবে এত পান খাওয়া শিখল এটা এক আজব ব্যাপার এখনো। তখন বাংলাদেশের বাজারে এক বিরা (৮০ পিচ) পানের দাম চার আনা, পশ্চিম পাকিস্তানে দশগুন বেশী দামে এসব পান বিক্রি হত। ১০ বিরা পান দিয়ে সাধারণ এক লোকের মাসিক থাকা–খাওয়া হয়ে যেত। বাংলাদেশ থেকে ফলমূলের বহর দেখে পাকিস্তানীরা অবাক হত। পাকিস্তানীদের অবাক করা চাহিদার জিনিহ ছিল নরসিংদী–ঢাকা অঞ্চলের ‘সাগর কলা’। ঢাকায় কর্মরত পাকিস্তানী প্রতিরক্ষাবাহিনী ও উচ্চ পদস্থ অফিসাররা ঢাকা থেকে করাচী ফ্লাইটে লাগেজ ভর্তি কলা নিত। যারা আর্মি, বিমান ও নৌ বাহিনীতে চাকরী করতেন তাদের জন্য ১০ কেজি অতিরিক্ত লাগেজ এর বন্দোবস্ত থাকত। তারা দশ কেজি আংগুর, আলুবোখারা ও কিসমিস নিয়ে দেশে ফিরতেন। আমাদের ছোটকালে আংগুর খাওয়া ছিল মৃত্যু–পূর্ব ‘শেষ ইচ্ছা’ অনেকের। মৃত্যুপথযাত্রীকে দেখতে গেলে সবাই আংগুর নিত। আর গ্রাম–গঞ্জে আংগুর এর দোকান তো ছিলই না। চট্টগ্রাম শহরে ও স্টেশন রোডে, আন্দরকিল্লায় কেবল দুই চারটা দোকানে আংগুর বিক্রি হত। যারা করাচী থেকে বিমানে দশ কেজি আংগুর নিয়ে আসত তারা অনেকটা আজকালকার দুবাই থেকে ‘গোল্ড’ নিয়ে আসার দামেই আংগুর বিক্রি করে দিত। আরেকটা ব্যাপার আমার কাছে যুব তাজ্জব মনে হত। পাকিস্তানের দূর প্রান্তের কোন শহর থেকে ঢাকা টু লাকসাম, দোহাজারী, নাজিরহাট টিকিট দেয়া হত ছুটিতে আসা বাংগালী কর্মকর্তা ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদেরকে। ঐ টিকেটেই ঢাকা থেকে সোজা বাংলাদেশের যে কোন প্রাান্তে। রেলের বোধ হয় তখন কর্মপন্থা বেশ নিয়মতান্ত্রিক ছিল।
যারা পাকিস্তান থেকে ছুটিতে আসত ওরা খুব সুন্দর সোয়েটার আনত। যেহেতু পাকিস্তানে শীতকালে প্রচন্ড শীত তাই ওখানে সস্তায় উলের কাপড় পাওয়া যেত।
প্রতিরক্ষা বাহিনীতে তেমন উচ্চ পদে কোন বাঙালী ছিল না। উচ্চ পদস্থদের মধ্যে জনাব ওসমানী, খাজা ওয়াসিউদ্দিন প্রমুখ। বিমান বাহিনীতে আমাদের অঞ্চলে স্কোয়াড্রন লীডার আফাজুর রহমান (নানুপুর–ফটিকছড়ি) ও উইং কমান্ডার সিরাজুল হক (ধলই, হাটহাজারী) এর নাম শোনা যেত। এলাকা থেকে সদ্য চাকরীপ্রাপ্ত ছেলেরা গেলে এই অফিসার থেকে যথেষ্ট গাইডেন্স পেত। প্রথমোক্ত স্কোয়াড্রন লীডার আফাজুর রহমান সাহেব চাকরী শেষে এলাকায় চাকরীদাতা হিসেবে কিংবদন্তী হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রাম স্টীল মিলের প্রধান থাকাকালে বিস্তর মানুষকে তিনি চাকরী দিয়েছেন। আফাজ সাহেব আর আমার ফুফা বন্ধু। উনি আসার সময় ১০ কেজি আংগুল–আলুবোখারা রেল–স্টেশনে আমাদের জন্য নামিয়ে দিতেন। সকালে বাড়ির সবাইকে বিলি করার পর আমাদের জন্য খুব অল্পই থাকত। অথচ আংগুর খাওয়ার ইচ্ছা ছিল প্রবল।
পাকিস্তানে বাংগালী ছেলেমেয়েরা খুব ভাল রেজাল্ট করত। তুলনামূলকভাবে আমরা যারা এদেশে পড়তাম বিষয়ক ভিত্তিক নম্বর কম পেতাম। পাকিস্তানে সাহিত্যে ও ছাত্ররা ৭০–৭৫ পেয়ে যেত। মোদ্দা কথা হল ওদের ওখানে টিচারগণ মুক্তহস্তে নম্বর দিতেন। আন্তর্জাতিক বৃত্তি প্রাপ্তিতে বাংগালীরা তাই পিছিয়ে যেত। কলেজ পর্যায়ে বাংলাদেশে সরকারী কলেজগুলোতে ভাল ছাত্র থাকলেও পাকিস্তানের তুলনায় কম নম্বর প্রাপ্তি একটা বড় সমস্যা ছিল। পাকিস্তানে অনেক বাংগালী বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজে পড়ত। ওখানে বাংগালীদের কোটা ছিল। সারগোদা, লোয়ার চৌপা (মারীতে) ইত্যাদি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। বিশ্ব বিদ্যালয় পর্যায়ে পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের বহু ছাত্র অনার্সে সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাকিস্তানে এম. এতে ভর্তি হয়ে ফার্স্ট ক্লাস নিশ্চিত করত। কারণ কমনওয়েলথ বৃত্তির জন্য একটি ফার্স্ট ক্লাস জরুরী ছিল।
পাকিস্তানীরা প্রকৃতিগতভাবে মাছ খেত না। কিন্তু বাংগালীরা ‘হাত–জাল’ নিয়ে যেত। ওরা নাকি ‘পাকিস্তানী সিন্ধু, ঝিলাম নদীসহ অনেক লেকে মাছ ধরে খেত।
যারা ছুটিতে আসত ওরা দুই প্রদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যটা বর্ণনা করত। দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে গড়ে ওঠে অজস্র মিল–কারখানা। বাংলাদেশের তরুণরা আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে দুই অঞ্চলের বৈষম্যের কথা শুনে শোষণমুক্তি তথা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত হয়। বঞ্চনার ২৪ বছরের সমাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট