ভূগোলের গোল

মানুষের জীবন-জীবিকা

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২২ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

বার্মা থেকে বাঙালি বিতাড়নের পাঁচ বছর পর ১৯৪৭ সালেপাকিস্তান এর অংশ হিসবে পূর্ব পাকিস্তান (বাংলা)ও স্বাধীনতা লাভ করে ঘরে ঘরে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পাঁচ বছরের বার্মাচ্যুত পরিবারগুলোতে এক নতুন সাইকোলজিকাল সমস্যা শুরু হয়। অনেক পরিবারের প্রধান ঘর থেকে বেরই হতেন না হতাশায়, অনেকে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে কারো সাথে কথাই বলতেন না। অনেকে আত্মহতা করে। আমার দাদা শোকে ‘গোর্দা ফেটে’ (এলাকার লোকের ভাষ্য) মারা যান। আমি এখন যেটা বুঝি উনি শোকে হার্ট এটাক করে মারা যান। পুরো চট্টগ্রামে এক বিষাদ বিরাজ করে।

নতুন দেশের নতুন রাজধানী হয় করাচি আরব সাগরের বন্দর শহর। পাকিস্তানের জাতির পিতা জিন্নাহ সাহেবের বাপদাদার ব্যবসায়িক কেন্দ্র। বোম্বাইওজরাট (জিন্নাহর পিতৃভূমি) এর কাছের বড় শহর করাচিকেই জিন্নাহ রাজধানী হিসেবে বেছে নেন। এখানেও চমকপদ কিছু ঐতিহাসিক তথ্য আছে। পাকিস্তানের টাকার নোটে জিন্নাহ সাহেবের ছবি থাকলেও জিন্নাহর জন্মভূমিতো ছিলই না পাকিস্তান। গভর্নর জেনারেল হিসাবে দিল্লী থেকে করাচি যাওয়ার প্রাক্কালে সাংবাদিকদের জিন্নাহ অদ্ভুত এক কথা বললেন। তিনি বললেন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন যেমন কয়েক বছরের জন্য ভারত শাসন করতে এসেছেন তেমনি আমিও কয়েক বছরের জন্য পাকিস্তান যাচ্ছি। আবার ভারতেই ফিরে আসব। আবার জিন্নাহ বা নব গঠিত পাকিস্তানের তেমন পয়সা ছিল না যে গভর্নর জেনারেল চার্টার্ড প্লেনে করাচি যাবেন। অথচ সম্মানের খাতিরে তা প্রয়োজন। দিল্লীকরাচি চার্টাড প্লেনের পয়সা দেন ইস্পাহানী সাহেব। তখন ইস্পাহানী জিন্নাহ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলেনআপনি তো করাচী চলে যাচ্ছেন, আমরা কোথায় যাব? উত্তরে জিন্নাহ বলেছিলেনতোমরা চট্টগ্রাম যাও। জিন্নাহ সাহেবের নাকি ইচ্ছে ছিল করাচি বন্দর নগরী হিসেবে যেমন রাজধানীর উপযোগী তেমনি চট্টগ্রাম ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে উপযোগী। তাই ইস্পাহানীসহ বাঘা বাঘা কর্পোরেটরা চট্টগ্রাম চলে আসেন। পরবর্তীতে খাজা নাজিমউদ্দিন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় নিয়ে যান।

১৯৪৭ পরবর্তী সময় বার্মার ‘চট্টগ্রামী দুর্যোগ’ ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে। শুরু হয় করাচি যাত্রার হিড়িক। করাচি পূর্ব থেকেই শিল্পসমৃদ্ধ ছিল। নতুন রাজধানী হিসেবে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। আবার এখনো করাচিমুম্বাইকোচিন সৃষ্টি হয়। আবার এখনো করাচিমুম্বাইকোচিন কলম্বো পানি পথে যাত্রীবাহী বহু জাহাজ সচল ছিল। আবার ডাক পড়ে চট্টগ্রামের খালাসী, সারেং ফের প্রচুর অশিক্ষিত লোক করাচির মিলকারখানা চাকরীর সন্ধানে যাওয়া শুরু করে। চট্টগ্রাম থেকে সকাল সন্ধ্যা দুটো প্যাসেঞ্জার শিপ কলম্বো হয়ে করাচি যেত। শুরুতে এক যাত্রার ভাড়া ছিল ৫১ টাকা। ১৯৭০ সালে এটা বেড়ে হয় ৮০ টাকা।

করাচিতে যারা কিছুই করতে পারত না তারা পানবিড়ির দোকান দিত। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের পানসুপারি, বিড়ি, কলাকাঠালের বড় সমঝদার খদ্দের ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির ডে১ থেকেই টেকনাফমহেশখালীর পান সুপারী ও ট্রপিকেল ফল মূল জাহাজ বোঝাই হয়ে করাচী যাত্রা শুরু হয়।

আমার গ্রামের অনেক কম শিক্ষিত তরুণ পানবিড়ির দোকান করত করাচি শহরে। ওরা দেশে আসলে স্যুট টাই পরে আসত। আমি আশ্চর্য হয়ে তাদের ‘টাই’ দেখতাম। আসার সময় পুরো লাগেজেই থাকত আংগুর, কিসমিস, আলু বোখারা আর ‘আহমদের সোহান হালুয়া’ (গোল পিচ শক্ত, ঘিয়ে ভেজা)। পাড়ার বাচ্চাদের দুই এক পিচ আংগুর আর হালুয়ার সামান্য টুকরা দিত। সেই যে আমার হালুয়া খাবার অভ্যাস তা এখনো বজায় আছে। গালফএ কর্মরত এলাকার লোকজন আমার জন্য এখনো সোহান হালুয়া নিয়ে আসে। এই পানির জাহাজ সম্ভতঃ কলম্বোয় ১২১৪ ঘন্টা থামত ও যাত্রীরা নামতেও পারত। করাচী থেকে ফিরতি যাত্রায় কলম্বো থেকে সবাই নারকেল তেল ও সিরামিকের প্লেট, চাকাপ আনত। তখন এ অঞ্চলে সিরামিকের আসবাবপত্র পাওয়া যেত।

শুধু শ্রীলংকায়, বার্মার ফুলওয়ালা দাদার প্লেটের অন্তিম যুগে বাবা যোগ করেন কলম্বো থেকে কেনা অসম্ভব সুন্দর কয়েক ডজন প্লেট। ভাঙতে ভাঙতে যে কয়টা ছিল প্রবাসী বোনের ছেলেরা মেয়েরা তাদের সন্তানদের এগুলো ‘এন্টিক’ হিসেবে দেখার জন্য নিয়ে গেছে।

করাচি পুরো পূর্ব পাকিস্তানে মেট্রিক পাস করা ছেলেদের জন্য চাকরির এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে। সেকেন্ড ডিভিশন পেলেই রিক্রুটমেন্ট অফিসে লাইনে দাঁড়াও। গাগতরে ঠিক থাকলেই চাকরি। হয়তো বিমান বাহিনী, নয়তো আর্মি বা নৌ বাহিনীতে চাকরী। যারা ভাল রেজাল্ট করত তাদেরকে টেকনিক্যাল লাইনে ভাল চাকরি দেওয়া হত। আর যারা থার্ড ডিভিশন পেত ওদেরকে অফিসে করনিক হিসেবে চাকরী দিত। তাদের প্রমোশন কম হত। চাকরিরত অবস্থায় যারা মেট্রিক মোটামুটি ভাল ছাত্র ছিল তাদের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় প্রাইভেট আই.. বিএ. এম এ পড়ার সুযোগ ছিল। অনেক কর্মরত বাঙালি করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রী নিত। ফলে এয়ার ফোর্সে এ কেরানী থেকে অফিসারও হতে পারত।

পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমান ঘাঁটি ছিল মৌরীপুর, করাচি। তার অদূরেই ছিল ড্রিগ রোড রেল স্টেশন ও করাচি সার্কুলার ট্রেন। এই দুই জায়গাতেই অধিকাংশ চট্টগ্রামের লোক বাস করত। মৌরিপুরে বাঙালি কলোনিগুলোর নাম ও ছিল মুসা কলোনী, চিটাগাং কলোনী ইত্যাদি। বাঙালিরা সাধারণত ইংলিশ মিডিয়ামেই বাচ্চাদের পড়াত। তবে বাংলা একটা বিষয় তারা শিখত। ১৯৭০ সাল নাগাদ প্রায় ৩০৪০ লাখ বাঙালি করাচিতে বসতি করে। অধিকাংশই চিটাগাং এর লোক।

বাঙালি সেনা, বিমান ও নৌ বাহিনীর রিক্রুটরা আসত অজ পাড়া গাঁ থেকে। ওদেরকে সোজা হোস্টেল এ নিয়ে অবধারিতভাবে পাকিস্তানি ‘সংস্কৃতি’ শেখার জন্য ‘পাঞ্জাবি’ সিন্ধি, বালুচ পাঠানদের রুম মেট দেয়া হত। অনেকে ছুটিতে দেশে আসলে এসব বিচিত্র, ভিন্ন পরিবেশে অভ্যস্ত হওয়ার গল্প বলত। এ গল্প কিছুটা মধুর, কিছুটা বৈরি, ট্রেনিং পর্ব শেষ হলে গোটা পাকিস্তানে তারা ছড়িয়ে পড়ত। একদেশ হলেও সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে এসব বাঙালি সন্তানদের খাপ খাইয়ে নিতে হত। প্রতি বৎসর মেট্রিক পরীক্ষায় বেশ ভাল সংখ্যক নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তানরা সামরিক বাহিনীতে চাকরির জন্য অপেক্ষা করত।

এখন যেমন হরেক দেশের জিনিসপত্র বাজারে সয়লাবতখন এরকম ছিল না। কিন্তু চাইনিজ জিনিসপত্রের চোরাকারবারের বড় জায়গা ছিল ‘লান্ডিকোঠাল’ নামের পাঠান ও আফগান সীমান্তের একটা জায়গা, লান্ডি কোঠালে কিছু উপজাতীয় বাস করত। ওদের নিজস্ব আইনে চলত সব। পাকিস্তানি থানাপুলিশের কোন কন্ট্রোল ছিল না ওই এলাকায়। চোরাকারবারীদের স্বর্গ ছিল লান্ডিকোঠাল। বাঙালি তরুণরা ছুটিতে এলে সুন্দর সুন্দর গিফট আনত আত্মীয় স্বজনদের জন্য। বাঙালিদের জন্য করাচিতে সবচেয়ে উপভোগের জিনিস ছিল রাস্তায় রাস্তায় ‘মালাই চা’ আর হরেক রকমের হালুয়া। ‘করাচি বেকারি’ নামে একটা চেইন শপ কেক্‌ আর হালুয়ার জন্য বৃটিশ আমলে বিখ্যাত ছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে এখনো ভারতের বড় বড় শহরে করাচি বেকারি নামের দোকান দেখতে পাওয়া যায়। মানুষ লম্বা লাইন দিয়ে কেক আর হালুয়া কিনে। দিল্লী একটা করাচি বেকারিতে আমি নিজেও বিশ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম।

মানুষের জীবনজীবিকার সময়স্থান ভেদে চালিত হয়। ৭০৮০ বছরের বার্মার ‘রংগীলা’ জীবনে পরিসমাপ্তি এভাবে মানুষের কাফেলা চেনাঅজানা ভিন্ন এক দেশে, করাচি, পেশোয়ার, লাহোর হয়ে উঠে জীবিকার নতুন শহর।

লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে কাজের তদারকির দায়িত্ব নিতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধনুরুল ইসলাম কোম্পানী